আল-কুরআন সংকলনের ইতিহাস

আল-কুরআন সংকলন - বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet


আল-কুরআন সংকলনের পদ্ধতি ও ইতিহাস

রাসুলুল্লাহ (স)-এর জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে পূর্ণাঙ্গ কুরআন সংকলন সম্ভব ছিল না। কেননা, তিনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত ওহি নাজিল অব্যাহত ছিল। তাছাড়া তখন এ সংকলন ততটা আবশ্যক হিসেবে দেখা দেয়নি। স্বয়ং নবি (স) ছিলেন জীবন্ত কুরআন। তাঁর অধিকাংশ সাহাবিই (রা) কুরআন মুখস্থ করে ও লিখে সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু মহানবি (স)-এর ইন্তেকালের পর খিলাফতে এমন কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা সংঘটিত হয় যার ফলে এই মহাগ্রন্থ সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়। তেমনি সংকটকালে আল-কুরআনের সংকলন অনিবার্য হয়ে পড়লে দুটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দুবারে আল-কুরআন সংকলনের কাজ সুসম্পন্ন হয়।

রাসুল (স)-এর যুগে কুরআন সংকলন

গ্রন্থাকারে সমুদয় কুরআন সংকলিত না হলেও রাসুল (স) এর যুগেই এর লিখিত সংকলন তৈরি হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (স) তাঁর প্রায় অর্ধশত সাহাবি (রা) কে 'কাতিবে ওহি' নিয়ােগ করে ওহি লেখার যে দায়িত্ব প্রদান করেন তাতেই এ মহাগ্রন্থের সংকলন সম্পন্ন হয়। সুরাসমূহের তারতিব, সুরা লিপিবদ্ধ করার প্রকৃতি, কোন আয়াতের পর কোন আয়াত লিপিবদ্ধ করতে হবে তার নির্দেশনা রাসুল (স) ওহির মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে মানুষের কাছে আজ যে কুরআন বিদ্যমান তা অবিকল রাসুলুল্লাহ (স) তাঁর সাহাবিদের কাছে রেখে যান। আল্লাহর নির্দেশে তিনি আয়াত, রুকু ও সুরার বিন্যাস করেছেন। কোনাে কোনাে সুরা একবারে নাজিল হয়েছে এবং কোনাে কোনাে সুরা খণ্ড খণ্ডভাবে নাজিল হয়েছে। কোন আয়াত কোন সুরার কান স্থানে স্থাপন করতে হবে তা তিনি বলে দিতেন এবং তদানুযায়ী তা রুকু ও সুরার অন্তর্ভুক্ত করা হতাে। কিন্তু এর গ্রন্থরূপ ছিল না।

হযরত আবু বকর (রা)-এর কুরআন সংকলন

ক. সংকলনের কারণ: রাসুলুল্লাহ (স)-এর ইন্তেকালের পর ভণ্ডনবিদের আবির্ভাব, যাযাবরদের ইসলাম ত্যাগ, একদল নওমুসলিমের জাকাতদানে অস্বীকৃতি এবং বাইরের শত্রুদের আক্রমণের আশঙ্কা ইসলামি খিলাফতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। এমন বিপর্যস্ত অবস্থা মােকাবিলার জন্য হযরত আবু বকর (রা) কে অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এর মধ্যে দ্বাদশ হিজরিতে (৬৩৩ খ্রি.) ভণ্ডনবি মুসায়লামাতুল কাযযাবের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইয়ামামার যুদ্ধ অন্যতম। এ যুদ্ধে দু'পক্ষেই বিপুল লােক হতাহত হয়। মুসলমানদের মধ্যে এমন সত্তর জন সাহাবি (রা) শাহাদতবরণ করেন যারা আল-কুরআনের হাফিজ বা পূর্ণ কুরআন মুখস্থকারী ছিলেন।

বহুসংখ্যক হাফেজে কুরআন সাহাবি (রা)-এর শাহাদতবরণ কুরআন মাজিদ সংরক্ষণ ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা প্রবল করে তােলে। সবার আগে হযরত উমর (রা) বিষয়টি উপলব্ধি করেন। তিনি স্পষ্টত প্রত্যক্ষ করেন যে, এভাবে কেবল মুখস্থ করে সম্পূর্ণ কুরআন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকলে এক সময়ে তার কোনাে না কোনাে অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে হযরত উমর (রা) খলিফা আবু বকর (রা)-এরদ কাছে যান এবং কুরআন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সব দিক থেকে সন্দেহমুক্ত রাখতে গ্রন্থাকারে সংকলনের প্রস্তাব দেন। হযরত আবু বকর (রা) প্রথম দিকে এ প্রস্তাবে সম্মতি না দিলেও পরে বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাষ্ট্রীয়ভাবে আল-কুরআন সংকলনের উদ্যোগ নেন এবং এ সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব রাসুলুল্লাহ (স)-এর প্রধান ওহি লেখক হাফেজ ও ক্বারি হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা)-এর ওপর অর্পণ করেন।

আরও পড়ুনঃ

খ. কুরআনের গ্রন্থ্রুপ দেওয়া: কুরআন সংকলনের সুকঠিন দায়িত্ব লাভের পর হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা) চারটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেন।

প্রথমত, সাহাবাদের (রা) স্মৃতিতে সুরক্ষিত কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের পারস্পরিক তুলনা ও নির্ভুলতা যাচাই।

দ্বিতীয়ত, হযরত উমর (রা)-এর ব্যক্তিগত পাণ্ডুলিপি ও স্মৃতির সাথে তুলনার মাধ্যমে সত্যতা যাচাই।

তৃতীয়ত, স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (স)-এর সামনে লিপিবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শী দু'জন সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে প্রতিটি আয়াতের অবিকৃতি নিশ্চিতকরণ এবং তারপর লিপিবদ্ধ করা।

চতুর্থত, চূড়ান্ত পর্যায়ে লিখিত আয়াতগুলাে অন্যান্য সাহাবি (রা) কর্তৃক লিখিত পাণ্ডুলিপির সাথে সুষ্ঠুভাবে যাচাই করে মূল পাণ্ডুলিপির অন্তর্ভুক্ত করা।

এভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা ও সংশয়মুক্ত হওয়ার পর কুরআন মাজিদের এক একটি শব্দ সুন্দরভাবে লিখিত হয় এবং সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি লেখা সমাপ্ত হয়। আল-কুরআনের এ সংকলন সম্পর্কে যায়েদ বিন সাবিত (রা) বর্ণনা করেছেন: "আমি কুরআন সংগ্রহের কাজে আত্মনিয়ােগ করলাম। তা খেজুর পাতা, পাথরখণ্ড ও লােকদের অন্তকরণ
থেকে সংগ্রহ করতে থাকলাম। এমনকি আমি সুরা তা শেষাংশ আবু খুযাইমা আল-আনসারীর কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম এবং আমি এ অংশ তিনি ছাড়া আর কারাে কাছে পাইনি"।

এরপর সম্পূর্ণ কুরআন মৃত্যু পর্যন্ত আবু বকর (রা)-এর কাছে গচ্ছিত থাকে। এরপর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত উমর (রা)-এর কাছে এটি সংরক্ষিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে উমর-তনয়া হাফসা (রা)-এর কাছে এটি সংরক্ষিত ছিল (সহিহ বুখারি)।

হযরত উসমান (রা)-এর কুরআন সংকলন

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে কুরআন মাজিদ সংকলনের সর্বজনীন উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়ে।

ক. সংকলনের কারণ: মূল কুরআন নাজিল হয়েছিল কুরাইশদের ব্যবহৃত আরবি ভাষায়। মহানবি (স) কুরআনের পঠন সহজতর করার জন্য মূল অর্থে কোনাে পার্থক্য না করে আরবদের বিভিন্ন আঞ্চলিক রীতিতে কুরআন তিলাওয়াতের অনুমতি দেন। সীমিত পরিসরে হওয়ায় এতে কোনাে সমস্যা ছিল না। কিন্তু নবিজির ইন্তেকালের পর ইসলাম আরবের সীমানা পেরিয়ে ইরাক, ইরান, সিরিয়া, মিসর, আফ্রিকা ও ইউরােপে ছড়িয়ে পড়লে কুরআন পাঠের গােত্রীয় ভিন্নতা ব্যাপক বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবি হুযায়ফা (রা) খলিফার কাছে কেবল কুরাইশ রীতিতে কুরআন পাঠের ব্যবস্থা করার নিবেদন করেন।

খ. সর্বজনীন সংকলন: পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য উসমান (রা) সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আঞ্চলিক বিকৃতিসম্পন্ন কুরআনের মতবিরােধপূর্ণ ব্যক্তিগত কপিসমূহ সংগ্রহ করেন এবং সাহাবাদের (রা) ঐকমত্যে সেগুলাে পুড়িয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কুরাইশদের ব্যবহৃত ভাষায় সবার জন্য উপযােগী একই পঠনরীতিতে সংকলিত এবং হযরত হাফসা (রা)-এর কাছে রক্ষিত কুরআন মাজিদের মূলকপি চেয়ে আনলেন। এ মাসহাফ সামনে রেখে সুরার তারতিবসহ কুরআন মাজিদের শুদ্ধতম মাসহাফ সংকলনের জন্য বিশেষজ্ঞ চারজন মাশহুর সাহাবি (রা) কে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলাে। কমিটির সদস্যরা হলেন হযরত যায়েদ বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, সাঈদ বিন আস ও আব্দুর রহমান বিন হারিস (রা)। তাঁরা মূল মাসহাফ থেকে এর সাতটি অনুলিপি তৈরি করে খিলাফতের গুরত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলােতে পাঠিয়ে দিলেন।

আল-কুরআনের এ সংকলন সম্পর্কে হযরত আনাস বিন মালিক (রা) বলেন, "হুযায়ফা বিন ইয়ামান উসমান (রা)-এর কাছে এমন সময় আসলেন যখন শাম ও ইরাকের লােকেরা আরমেনিয়া ও আজারবাইজান বিজয়ের সংগ্রামে লিপ্ত ছিল"। হুযায়ফা (রা) কুরআনের বিভিন্ন রকমের পাঠের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন। তাই তিনি উসমান (রা) কে বললেন- হে আমিরুল মুমেনিন, এ জাতি কিতাব সম্পর্কে মতপার্থক্যে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে এদেরকে রক্ষা করুন। যেমন এরপূর্বে ইহুদি ও নাসারারা লিপ্ত হয়েছিল। যেজন্য উসমান (রা) হাফসা (রা)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তিকে এ বলে পাঠালেন যে, আপনার কাছে সংরক্ষিত কুরআনের লিপিসমূহ আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমরা কুরআনকে একখানি পরিপূর্ণ গ্রন্থাকারে সন্নিবেশিত করতে পারি। এরপর মূললিপি আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব।'

হাফসা (রা) যখন মূললিপি উসমান (রা) এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন তখন উসমান (রা) যায়েদ বিন সাবিত, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়র, সাঈদ বিন আস ও আব্দুর রহমান বিন হারিস বিন হিশাম (রা) কে কুরআন পুনঃলিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন উসমান (রা) তিনজন কুরাইশকে বললেন, যে ক্ষেত্রে তােমরা যায়েদের সাথে কুরআনের কোনাে ব্যাপারে দ্বিমত পােষণদ করবে, সেক্ষেত্রে তােমরা কুরাইশদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করবে, কেননা কুরআন তাদের ভাষায় নাজিল হয়েছে। অতএব তারা তাই করলেন এবং যখন অনেক কপি লেখা হয়ে গেল তখন উসমান (রা) মূলকপি হাফসা (রা)-এর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এরপর উসমান (রা) প্রত্যেক প্রদেশে করআনের কপিসমূহর এক একখানা পাঠিয়ে দিলেন এবং সাথে সাথে নির্দেশ দিলেন অন্যান্য লিখিত যে কপিসমূহ রয়েছে আলাদা আলাদা অথবা একত্রে সেসব যেন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় (সহিহ বুখারি)।

কুরআন সংকলনে যুগান্তকারী এ ভূমিকার জন্য হযরত উসমান (রা) ইতিহাসখ্যাত হন জামিউল কুরআন বা কুরআন সংকলক, সংগ্রাহক বা একত্রকারী নামে। আর এভাবেই প্রথমে হযরত আবু বকর (রা) এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে হযরত উসমান (রা)-এর প্রচেষ্টায় আল-কুরআনের পরিপূর্ণ সংকলন সমাপ্ত হয়।



তথ্যসূত্র:

বই: ইসলাম শিক্ষা - দ্বিতীয় পত্র
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী
-----------------------------------
ড. এ আর এম আলী হায়দার
ড. মোঃ রেজাউল করিম
ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল
ড. মুহাম্মদ আল আমীন

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন