আল-কুরআনের সংরক্ষণ পদ্ধতি ও ইতিহাস

আল-কুরআনের সংরক্ষণ -  বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet

আল-কুরআন সংরক্ষণের পদ্ধতি ও ইতিহাস

কুরআন মাজিদ অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত ও চিরন্তন সত্যের ধারক আসমানি গ্রন্থ। অনন্তকাল ধরে এ মহাগ্রন্থ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসীম সত্তায় বিরাজমান। ইরশাদ হচ্ছে - "আল্লাহ যা ইচ্ছা মুছে দেন এবং বহাল রাখেন। আর মূল কিতাব তা তাঁর কাছেই রয়েছে" (সুরা রাদ: ৩৯)

কুরআন অবতীর্ণের সময়ে এর সংরক্ষণ ছিল তাঁর অসীম সত্তার মতােই অবিনশ্বর। তারপর আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপযােগী করে এ মহাগ্রন্থ নাজিল করেন। তার পবিত্রতম সত্তা থেকে নাজিল হওয়ার পর কুরআন মাজিদ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

লাওহে মাহফুজে সংরক্ষণ

সম্পূর্ণ কুরআন সর্বপ্রথম সংরক্ষিত হয় লাওহে মাহফুজ বা সুরক্ষিত ফলকে। আল্লাহ বলেন - "বরং এটাতো মর্যাদাময় কুরআন, লাওহে মাহফুজে সুরক্ষিত" (সুরা আল বুরুজ: ২১-২২)

এখানে আল-কুরআন নাজিলের সময় আল্লাহর নির্দেশে অগণিত ফেরেশতা নিয়ােজিত থাকেন। নাজিল সম্পন্ন হওয়ার পর সত্তর হাজার মর্যাদাবান ফেরেশতা এর সংরক্ষণ কাজে নিয়ােগ পান। তাঁরা অকল্পনীয় নিষ্ঠায় অনাদিকাল থেকে এ মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করছেন।

বায়তুল ইযযায় সংরক্ষণ

বায়তুল মামুরের অপর নাম বায়তুল ইযযাহ। এটি বায়তুল্লাহ বরাবর পৃথিবীর নিকটতম আসমানে (সপ্তম আসমান) অবস্থিত। এটি ফেরেশতাদের ইবাদতগৃহ। কদর রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা একসঙ্গে বায়তুল ইযযাহ নামক স্থানে সমগ্র কুরআন নাজিল করেন। এখানে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ফেরেশতাদের একটি দল কুরআন সংরক্ষণের কাজে নিয়ােজিত আছেন। তাঁরা শয়তানের হস্তক্ষেপ থেকে কুরআনের পবিত্রতা সংরক্ষণ করেন। শয়তান যেন এ মহাগ্রন্থে কোনাে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখেন।

পৃথিবীতে অবতরণ এবং সংরক্ষণের নিশ্চয়তা

বায়তুল ইযযাহ থেকে এক বছরের প্রয়ােজনীয় আয়াতমালা হযরত জিবরাইল (আ)-এরওপর নাজিল হয়। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রমজান মাসের কদর রাত্রিতে তিনি মুহাম্মদ (স)-এর কাছে পৌছে দেন আল্লাহর বরকতময় বাণী। কুরআন নাজিলের সাথে সাথে মহানবি (স) তা সংরক্ষণের জন্য দ্রুত মুখস্থের চেষ্টা করেন। এ নিয়ে তাঁর পেরেশানি চরম পর্যায়ে পৌছলে, আল্লাহ তায়ালা চিন্তামুক্ত থাকার নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন - "তাড়াতাড়ি শিখে নেওয়ার জন্য দ্রুত আবৃত্তি করবেন না। এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্ব (সুরা আল-কিয়ামাহ: ১৬-১৭)

তিনি আরও বলেন - "নিশ্চয়ই আমি এই কুরআন নাজিল করেছি এবং সুনিশ্চিতভাবে আমিই তার সংরক্ষক" (সুরা হিজর; ৯)।

তাছাড়া এতে কোনাে চেষ্টাতেই মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটানাে যাবে না। আল্লাহ বলেন- "এ কুরআনে মিথ্যা অনুপ্রবেশ করবে না। না পেছন থেকে, না সামনে থেকে। বিজ্ঞানময় ও প্রশংসিতের পক্ষ থেকে তা অবতীর্ণ (সুরা হা-মীম আস্ সেজদাহ: ৪২)

রাসুল (স)-এর যুগে সংরক্ষণ 

আল-কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, সময় হলাে রাসুল (স) এর যুগ। এ সময়ে এ মহাগ্রন্থের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তিনটি সাধারণ পদ্ধতি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

১. হিফজ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ: নিরক্ষর আরবদের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। আরব কবিদের সুদীর্ঘ কাব্য এবং নিজেদের পরিপূর্ণ বংশতালিকা মুখস্থ করে রাখায় তারা অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করেন। কুরআন নাজিল শুরু হওয়ার পর তাদের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এর সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ক. রাসুলুল্লাহ (স)-এর ব্যক্তিগত প্রয়াস: নবি (স) নিজেও অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন। তা সত্ত্বেও আল-কুরআনের যখন যেটুকু নাজিল হতাে তিনি সাথে সাথে তা কণ্ঠস্থ করে নিতেন। ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, "জিবরাঈল (আ) যখনই ওহি নিয়ে আসতেন, নবি (স) মাথা নুইয়ে চুপ করে শুনতেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী পুরাে ওহিই যথাযথভাবে পড়তে পারতেন" (সহিহ বুখারি)। এভাবে কুরআন নাজিল অব্যাহত থাকায় মহানবি (স) নিজে জীবন্ত কুরআনে পরিণত হন।

আরও পড়ুনঃ

খ. সাহাবিদের হিফজ: মহানবি (স)-এর সাহাবিগণ আল-কুরআন হিফজ বা মুখস্থ করে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। কোনাে আয়াত নাজিল হলে প্রথমে রাসুলুল্লাহ (স) তা পাঠ করে শােনাতেন, পরে তাঁর সাহাবিদের তা পাঠ করে শােনাতে বলতেন। এভাবে মুখস্থ হয়ে যেত। বিরে মাউনের ঘটনায় ৭০ জন কুররা শহিদ হন। ইয়ামামার যুদ্ধে শহিদ কুররা সংখ্যা সত্তরের অধিক। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, তখন অনেকেই কুরআন হিফজ করতেন। এমনিতেই আরবরা বিস্ময়কর স্মরণশক্তির অধিকারী, তদুপরি কুরআন হিফজ করা ছিল গৌরব ও মর্যাদার কাজ, তাই তাঁরা অবলীলাক্রমে কুরআন মুখস্থ করতেন। এ সময় বিশিষ্ট সাহাবিদের মধ্যে আবু বকর, উমর, উসমান, আলি, ইবন মাসউদ, ইবন উমর, ইবন আমর, সালিম, উবাই বিন কাআব, মুআয, তালহা, সাদ, আবু হুরায়রা, আয়শা, হাফসা, উম্মে সালমা প্রমুখ সাহাবি (রা) ছিলেন অন্যতম। তাছাড়া পারিবারিকভাবেও সাহাবিগণ (রা) আল-কুরআন তিলাওয়াত করতেন। গভীর রাতে তাঁদের ঘর থেকে কুরআন তিলাওয়াতের পবিত্র ধ্বনি উত্থিত হতাে। রাসুলুল্লাহ (স) রাতের বেলায় তাঁদের তিলাওয়াত শুনতে বাইরে বের হতেন।

জিবরাইল (আ)-এর পুনরাবৃত্তি: সর্বোপরি, প্রতি রমজানে হযরত মুহাম্মদ (স) ততদিন পর্যন্ত কুরআনের নাজিলকৃত আয়াতমালা জিবরাইল (আ)-এর কাছে এবং জিবরাইল (আ) তাঁর কাছে পুনরাবৃত্তি করতেন। কোনাে কোনাে বর্ণনায় আছে, প্রতি রমজানে জিবরাইল (আ) পুরাে কুরআন মাজিদ একবার রাসুলুল্লাহ (স) কে তিলাওয়াত করে শােনাতেন। আর এভাবে মহানবি (স) ও সাহাবিদের (রা) স্মৃতিপটে আল-কুরআন নিরন্তর সংরক্ষিত হতে থাকে।

২. লেখনীর মাধ্যমে সংরক্ষণ: যদিও কুরআন নাজিলকালীন সময়ে লিখতে জানা লােকের সংখ্যা ছিল কম, তা সত্ত্বেও যারা লেখাপড়া জানতেন তাঁরা মুখস্থ করার পাশাপাশি লিখেও আল-কুরআনের সংরক্ষণ অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে লেখনীর সাজ-সরঞ্জামের অপ্রতুলতার জন্য সাহাবিগণ (রা) চামড়া, পাথর, পাতা, হাড় প্রভৃতিতে অসীম ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে কুরআনের আয়াত লিখে রাখার কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।

৩. কাতিবে ওহি নিয়ােগ: রাসুলুল্লাহ (স) নিজে লিখতে-পড়তে পারতেন না। কিন্তু তাঁর কাছে প্রথমে যে বাণী এসেছে তাতে 'কলম' ব্যবহারের কথা আছে। আল-কুরআনকে 'আল-কিতাব' বলে মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। কিতাবতাে তাকেই বলা হয় যা কলম দ্বারা লিখিত হয়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কুরআন সংরক্ষণের কাজ সম্পাদনের জন্য তাই নবি (স) কাতিবে ওহি বা ওহি লেখক নিয়ােগ করেন। রাসুলুল্লাহ (স)-এর দরবারে ৪২ জন কাতিব ছিলেন, যারা ওহি নাজিল হলে তাঁর নির্দেশে তা লিপিবদ্ধ করতেন। এদের মধ্যে যায়েদ ইবন সাবিত, আবু বকর, উমর, উসমান, আলি, যুবায়র বিন আওয়াম, সাদ, খালিদ বিন সাঈদ, আবান বিন সাঈদ, উবাই বিন কাআব, হানযালা বিন রাভী, মুআইকাব বিন আবি ফাতিমা, আরকাম, আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা, খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুগীরা বিন শুবা, মুআবিয়া, আমর বিন আস, আব্দুল্লাহ বিন সারাহ (রা) প্রমুখ সাহাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এ সময়ে ওহি লিখনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে সাহাবাগণ (রা) বিভিন্ন বর্ণনা পেশ করেছেন। এ সম্পর্কে হযরত যায়দ বিন সাবিত (রা) বলেন, "নাজিল শেষ হলে আমি দুম্বার চামড়া, হাড় ও লিখন উপযােগী অন্য কিছু নিয়ে হাজির হতাম। লেখা শেষ হলে রাসুলুল্লাহ (স) বলতেন- যা লিখেছাে আমাকে পড়ে শােনাও।" আমি লিখিত অংশ পড়ে শােনাতাম। কোথাও কোনাে ত্রুটি -বিচ্যুতি থাকলে নবি (স) সাথে সাথে তা শুদ্ধ করে দিতেন। এরপর সংশ্লিষ্ট অংশটুকু অন্যদের সামনে তিলাওয়াত করতেন। লিখিত পান্ডুলিপিগুলাে মহানবি (স) নিজ তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণ করেন।

খুলাফায়ে রাশিদিনের যুগে সংরক্ষণ

রাসুলুল্লাহ (স)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর (রা) এর খিলাফতকালে কুরআন সংরক্ষণ প্রক্রিয়া নতুন যুগে প্রবেশ করে। তাঁর শাসনামলে হযরত উমর (রা)-এর পরামর্শে ও যায়েদ বিন সাবিত (রা)-এর তত্ত্বাবধানে সমগ্র কুরআন গ্রন্থাবন্ধ করা হয়। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা) তার খিলাফতকালে দ্বিতীয়বার সংকলন করার পর মূল কুরআন এর অনুলিপি তৈরি করিয়ে তা খিলাফতের সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। ফলে আল-কুরআনের সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি সারা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে সে অনুলিপিরই মুদ্রিতরূপ প্রচলিত রয়েছে।

পরবর্তীকালে সংরক্ষণ

উমাইয়া খিলাফতকালে অনারবদের কাছে আল-কুরআনের সংরক্ষণ সহজসাধ্য করে তুলতে আবুল আসওয়াদ দোয়ালী, ফারাহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যাকরণবিদদের সহযােগিতায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আল-কুরআনে হরকত ও নুকতা সংযুক্ত করেন। এখন বিশ্বের দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়া মুসলিম জনগােষ্ঠী একদিকে যেমন সর্বাধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে ছাপানাে নির্ভুল গ্রন্থাবদ্ধ কুরআন নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করেন, তেমনি অসংখ্য মুসলিম গােটা কুরআন মাজিদ মুখস্থ করে এ মহাগ্রন্থের সংরক্ষণ কাজ সবদিক থেকেই নিরাপদ ও নিশ্ছিদ্র রেখেছেন। ফলে পৃথিবীর যেকোনাে প্রান্তের মুসলিম সাধারণ একটি ই'রাবের (যবর, যের, পেশ, জযম) গরমিল করেও কুরআন তিলাওয়াত করেন না। বস্তুত মহান আল্লাহ স্বয়ং কুরআন মাজিদ সংরক্ষণের যে দায়িত্ব নিয়েছেন, এ হচ্ছে তারই বাস্তব প্রমাণ।



তথ্যসূত্র:

বই: ইসলাম শিক্ষা - দ্বিতীয় পত্র
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী
-----------------------------------
ড. এ আর এম আলী হায়দার
ড. মোঃ রেজাউল করিম
ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল
ড. মুহাম্মদ আল আমীন

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন