মিসওয়াক করার গুরুত্ব, ফযিলত ও পদ্ধতি

মিসওয়াক (Miswak) করার নিয়ম ও উপকারিতা

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুবই তাগিদ দিয়েছেন। মিসওয়াক করা রাসূল (সা.) এর সুন্নাত সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি সুন্নাহ। তিনি নিয়মিত মিসওয়াক করতেন। অযু এবং গোসল করার পূর্বে মিসওয়াক করা সুন্নত। এছাড়া যেকোন ভালো কাজের পূর্বে নবীজি (সাঃ) মিসওয়াক করতেন। মিসওয়াক করা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অংশ। কোন ঈমানদার ব্যাক্তি এমন হতে পারে না যে, মুখ পরিষ্কার না করার কারণে মুখ থেকে দূর্গন্ধ আসবে।


মিসওয়াক কী?

মিসওয়াক শব্দটি আরবি শব্দ, মিসওয়াক এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘দাঁতন’। সাধারণত মিসওয়াক বলতে বুঝানো হয় দাঁত মাজার উপকরণ কে। দাঁত থেকে হলুদ বর্ণ বা এ জাতীয় ময়লা দূর করার জন্য বিভিন্ন গাছের ডাল ও কাঠের টুকরা ব্যবহার করাকে মিসওয়াক বলা হয়। মিসওয়াক হচ্ছে ব্রাশ এর প্রাথমিক রূপ। এটি মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুন্নাহ পদ্ধতি। 


ব্রাশ ও মিসওয়াক এর পার্থক্য

টুথব্রাশ একবার ব্যবহার করার ফলে তার মধ্যে জীবাণু জমা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পানি দিয়ে পরিষ্কার করলেও জীবাণু ধ্বংস হয় না। ব্রাশ বারংবার ব্যবহার করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ব্রাশ এর ব্যবহারে দাঁতের ওপরের ঔজল্ল্য এবং সাদা আবরণ উঠে যায়। এর ফলে মাড়ির মাঝের ফাঁকও বেড়ে যায় এবং মাড়ির স্থান ছুটে যেতে থাকে, যার কারণে সে ফাঁকা স্থানে খাদ্য আটকে থাকে এবং দাঁতে বিভিন্ন ধরনের রোগের সংক্রামণ দেখা দেয়।

মিসওয়াক রাসূল (সা.) এর একটি সুন্নাত। মিসওয়াক করলে নেকীর অধিকারী হওয়া যায়। মিসওয়াকে ভেষজ জাতীয় পদার্থ থাকে যা দাঁতের জন্য খুবই উপকারী এবং সব ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত এবং কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। ডেন্টাল স্বাস্থ্য বিধির ক্ষেত্রে মিসওয়াক ব্যবহার খুবই উপযোগী।


মিসওয়াক এর গুরুত্ব

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন : “আমার উম্মাতের জন্য কষ্টকর হবার সম্ভাবনা না থাকলে আমি প্রত্যেক সলাতের জন্য মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম।” (সহিহ ফাযায়েলে আমল, হাদিস নং ৯৭)

আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যখনই জিবরীল (আঃ) আমার নিকট আসতেন, তখনই আমাকে মিসওয়াক করার জন্য বলতেন, যাতে আমার ভয় হতে লাগলো যে, আমি আমার মুখের সম্মুখ দিক ক্ষয় করে দিব। (মিশকাতে জয়িফ হাদিস, হাদিস নং ৯২)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “আমার উম্মতের উপর যদি কষ্টকর মনে না করতাম, তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক নামাযের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ করতাম।” (বুখারী ৮৮৭, মুসলিম ২৫২)

আমির ইবনু রবী‘আহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সওম অবস্থায় এতবার মিসওয়াক করতে দেখেছি যে, তা আমি হিসাব করতে পারি না। (আবূ দাঊদ ২৩৬২, তিরমিযী ৭২৫)

আরও পড়ুন :

মিসওয়াক কিভাবে তৈরি করবেন?

গাছের কাচা ডাল, বাঁশের কাঁচা কঞ্চি বা শিকড় দিয়ে মিসওয়াক তৈরি করা হয়। আরবদেশ সমূহে দাঁত পরিষ্কার করার জন্য ‘স্যালভাদরা পারসিকা’ নামক এক ধরনের গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক বানানো হয়। এই গাছকে আরবিতে ‘আরাক’ গাছও বলা হয়ে থাকে। তাছাড়া নিম,জায়তুন,পিলু,বাবলা,কানির জাতীয় তেঁতো, লবনাক্ত গাছের নরম আশঁযুক্ত ডাল ব্যবহার করে মিসওয়াক তৈরি করা হয়। আমাদের দেশে যে সমস্ত মিসওয়াক পাওয়া যায় এগুলো সাধারনত পীলু বা যয়তুন গাছের ডাল। এ সব গাছ ছাড়াও বিভিন্ন গাছের ডালকে মিসওয়াক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে বিষাক্ত গাছের ডাল বা যে গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করতে কষ্ট হয় এমন ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা উচিত নয়। রাসূল (সাঃ) জায়তুন এবং খেজুর গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াক করেছেন। তাই এই দুইটিই উত্তম।

মিসওয়াক নিজ হাতের আঙ্গুল পরিমাণ মোটা ও আধাহাত পরিমাণ লম্বা হওয়া উত্তম।


মিসওয়াক (Miswak) করার নিয়ম ও উপকারিতা
মিসওয়াক ধরার পদ্ধতি

মিসওয়াক ব্যবহার করার নিয়ম বা পদ্ধতি

মিসওয়াক করার সুন্নত নিয়ম হচ্ছে, কনিষ্ট বা কানি আঙ্গুল মিসওয়াকের নিচে থাকবে এবং বুড়ো বা বৃদ্ধাঙ্গুল উপরের দিকে মিসওয়াকের মুখের নিচে থাকবে। বাকী আঙ্গুলগুলো মিসওয়াক এর উপরে থাকবে। প্রথমে ডান দিকের উপরের দাত, তারপর বাম দিকের উপরের দাত, এভাবে ডান দিকের নিচের দাত এবং বাম দিকের নিচের দাত মিসওয়াক করবে। এইভাবে প্রথমে একবার মিসওয়াক করে তারপর যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে মিসওয়াক করা যাবে।


মিসওয়াক করার নিয়ত ও দোয়া

মিসওয়াক করার সময় মনে মনে নিয়ত করতে হবে।  যেমন, আমি নামাজে আল্লাহর যিকির করার জন্য অথবা কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করার জন্য আমার মুখ পবিত্র করছি।

মিসওায়াক শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ বলে এই দোয়া পড়বে। 
بِسْمِ اللهِ اَللّهُمَّ اجْعَلْ سِوَاكِيْ هذَا مَحِيْصًا لِّذُنُوْبِيْ وَمَرْضَاةً لَّكَ وَبَيِّضْ بِه وَجْهِيْ كَمَا بَيّضْتَ أَسْنَانِيْ. 
অর্থ- ইয়া আল্লাহ, এই মিসওয়াক করাকে আমার পাপ মোচনকারী ও তোমর রেজামন্দীর ওসীলা বানাও, আর আমার দাঁতগুলিকে যেমনি তুমি সুন্দর করেছ, তেনি আমার চেহারাকেও উজ্জ্বল (সুন্দর) কর।


মিসওয়াক এর উপকারিতা 

মিসওয়াক জীবাণু ধ্বংসকারী এন্টিসেপ্টিক এর কাজ করে। মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। আমাদের মুখে এমন কিছু জীবাণু সৃষ্টি হয়, যা প্রচলিত ব্রাশ এবং পেষ্ট দ্বারা দূর হয় না। সেগুলোকে শুধুমাত্র মিসওয়াকের মাধ্যমেই ধ্বংস করা যেতে পারে। নিয়মিত মিসওয়াক ব্যবহার করলে টনসিলের রোগ খুবই কম হয়। 
প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকমের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করার সময় খাবারের ছোট-ছোট কণা দাঁতের ফাঁকে জমতে থাকে, যা সাধারণত কুলি করার দ্বারা দূর হয় না। ফলে দুর্গন্ধ এবং জীবাণুর কারণে মুখের ভেতর ফোঁড়া হয়ে ঘা এর সৃষ্টি হয়। নিয়মিত মিসওয়াক করলে এরুপ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।


মিসওয়াক এর ফজিলত

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি মিসওয়াক করার আদেশ দিয়ে বলেন, নাবী (সাঃ) বলেছেন : বান্দা যখন মিসওয়াক করে, অতঃপর দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করে, তখন তার পিছনে একজন ফিরিশতা দাঁড়ায় এবং মনোযোগ দিয়ে তার ক্বিরাআত শুনে। অতঃপর ফিরিশতা তার অতি নিকটবর্তী হয় এমনকি ফিরিশতার নিজের মুখ তার মুখের উপর রাখেন। তখন তার মুখ থেকে কুরআনের যা কিছুই তিলাওয়াত বের হয় তা ফিরিশতার উদরে প্রবেশ করে। কাজেই তোমরা তোমাদের মুখকে পবিত্র রাখো কুরআনের জন্য। (সহিহ ফাযায়েলে আমল, হাদিস নং ৯৬)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে সালাত মিসওয়াক করে আদায় করা হয়, সেই সালাতে মিসওয়াক করা বিহীন সালাতের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী নেকী হয়। (মিশকাতে জয়িফ হাদিস, হাদিস নং ৯৩)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির লাভের উপায়। (সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৫, হাদিসের মান সহিহ)

আল্লাহ তা'য়ালা আমদেরকে মিসওয়াক এর উপর আমল করার তাওফিক দান করুন।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন