কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত

কুরআন তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত -  বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet

তিলাওয়াত অর্থ আবৃত্তি বা পাঠ করা, অনুধাবন ও অনুসরণ করা। আল-কুরআন পাঠ করাকে ইসলামি পরিভাষায় কুরআন তিলাওয়াত বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত ইবাদতের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নামাযের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত রয়েছে যা কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া সম্ভব হয় না। সাধারণ ইবাদত হিসেবেও কুরআন তিলাওয়াতের অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। আল্লাহর বিশেষ সান্নিধ্য লাভের যেসব সুযােগ রয়েছে, সেগুলাের অন্যতন হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত। প্রয়ােজনীয় সব বিধান ও মূলনীতিই এখানে রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স)-এর রিসালাতের মূল দায়িত্ব ছিল মানুষের কাছে কুরআন পৌছে দেওয়া। ইব্রাহিম (আ) তাঁর প্রার্থনায় এজন্যই উল্লেখ করেছেন, "হে আমাদের প্রভু! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের জন্য একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন (সুরা আল-বাকারা; ১২৯)।

আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান পেশ করেছেন। সেজন্য কুরআন মাজিদের তিলাওয়াত যেমন ফজিলতপূর্ণ তেমনি গুরুত্ববহ। বিভিন্নভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন -

আল্লাহর নির্দেশ: কুরআন তিলাওয়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, "তােমার প্রতি কিতাবের যা ওহি হয়েছে তা তিলাওয়াত করাে (সুরা আল-আনকাবুত: ৪৫)

"পড় তােমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন (সুরা আলাক; ১)

সহিহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। তিনি বলেছেন, "আর তুমি সুবিন্যস্ত ও স্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াত করাে (সুরা মুযযামমিল: ৪)

অবশ্য তিলাওয়াতের জন্য তিনি কোনাে পরিমাণ নির্ধারণ করে দেননি। বরং তাঁর অপার অনুগ্রহের নিদর্শন রেখে নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন- আল্লাহ বলেন, "কাজেই কুরআনের যতটুকু তিলাওয়াত করা সহজ তােমরা ততটুকু তিলাওয়াত কর" (সুরা মুযযামমিল: ২০)

জ্ঞানভাণ্ডার: কুরআন মাজিদ সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাণ্ডার। অতীত জাতির ইতিহাস, বর্তমান ঘটনা বিশ্লেষণ এবং নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে কুরআন সর্বতোভাবে নির্ভুল উৎস। আইন, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য প্রতিটি বিষয়েই কুরআন নীতিনির্ধারক গ্রন্থ। এমন কোনাে বিষয় নেই যার তথ্য কুরআন মাজিদে পরিবেশিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন - "আর আমি তােমার ওপর কিতাব নাজিল করেছি, যাতে সব বিষয়ের বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে (সুরা আন-নাহল; ৮৯)

শান্তি ও রহমত লাভ: নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ব্যক্তির মনে প্রশাস্তি এনে দেয়। মহানবি (স) যখনই কোনাে বিপদে বা শঙ্কায় পতিত হতেন তখনই তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তাছাড়া এ মহাগ্রন্থের তিলাওয়াতে আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়। এ প্রসঙ্গে মহানবি (স) ইরশাদ করেন, "কোনাে জাতি বা গােষ্ঠী যখন আল্লাহর ঘরসমূহের কোনাে একটি ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, পরস্পরের মধ্যে এর শিক্ষা অনুশীলন করে, তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহর রহমত তাদের বেষ্টন করে রাখে, ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তায়ালা তার নিকটস্থ ফেরেশতাদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন" (সহিহ মুসলিম)

সর্বোত্তম নফল ইবাদত: আল-কুরআনের তিলাওয়াত নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। মহানবি (স) ইরশাদ করেন, "আমার উম্মতের সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে কুরআন পাঠ (বায়হাকি)।

ইমাম আযম আবু হানিফা (র) বলেন, "আমি সত্তর বার স্বপ্নযােগে নবি করিম (স) কে জিজ্ঞাসা করেছি, সর্বোত্তম নফল ইবাদত কোনটি? রাসুল (স) প্রতিবারই বলেছেন, কুরআন তিলাওয়াত"।

আরও পড়ুনঃ

মর্যাদালাভ: কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে তিলাওয়াতকারী, তার পরিবার এমনকি তার সমাজও মর্যাদালাভ করে। নবি করিম (স) ইরশাদ করেন, অর্থ: তােমাদের মধ্যে উত্তম লােক সে, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে তা শিক্ষা দেয় (বুখারি ও মুসলিম)।

জান্নাত ও শাফায়াতের মর্যাদালাভ: কুরআন তিলাওয়াত ব্যক্তিকে পরকালে জান্নাতলাভ এবং অন্যদের জন্য সুপারিশ করার মর্যাদা এনে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স) বলেন - "যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে, তা মুখস্থ করে এবং হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম জানে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্য থেকে এমন দশ ব্যক্তির জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন যাদের প্রত্যেকের জন্যই জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল (সুনান আত-তিরমিযি)।

সওয়াবলাভ: কুরআন মাজিদ আল্লাহর কালাম। পবিত্রতম এ কালামের তিলাওয়াতও তাই সওয়াব লাভের এক বিশেষ মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে নবি করিম (স) বলেন - "যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ তিলাওয়াত করে, সে একটি নেকি পায় আর এ প্রত্যেকটি নেকি দশটি নেকির সমান (সুনান আত-তিরমিযি)।

আল্লাহর সাথে বাক্যালাপ: কুরআন মাজিদ আল্লাহর বাণী। রাসুলুল্লাহ (স) এ জন্যই বলেছেন, "তােমাদের মধ্যে কেউ যদি আল্লাহর সাথে কথা বলতে চায়, সে যেন বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করে" (সহিহ মুসলিম)

কুরআনের সুপারিশ: এ মর্মে মহানবি (স) ঘােষণা করেন - "তােমরা কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করাে। কারণ কিয়ামতের দিন তা স্বীয় তিলাওয়াতকারীর মুক্তির জন্য সুপারিশ করবে (সহিহ মুসলিম)।

নবি করিম (স) আরও বলেন, "সাওম ও কুরআন বান্দাদের শাফায়াত করবে। কুরআন বলবে, 'হে আল্লাহ! আমি তাকে রাতের শয্যা গ্রহণ করতে বিরত রেখেছি; তার জন্য আমি সুপারিশ করছি, আমার শাফায়াত কবুল করাে। অতঃপর উভয়ের শাফায়াত কবুল করা হবে" (মুসনাদে আহমদ)।

আত্মিক পবিত্রতা লাভ: কুরআন তিলাওয়াত ব্যক্তির অন্তরের কলুষ-কালিমা বিদূরিত করে। রাসুলুল্লাহ (স) বলেন- "নিশ্চয়ই এ অন্তরেও মরিচা পড়ে, যেমন পানি পড়লে লােহায় মরিচা পড়ে। বলা হলাে, হে আল্লাহর রাসুল (স) এ মরিচা দূর করার উপায় কী? তিনি বললেন, বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা (মিশকাত)।

শুদ্ধ তিলাওয়াতের গুরুত্ব: আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনের শুদ্ধ তিলাওয়াতের ওপর গুরুত্বারােপ করে বলেছেন - "আর তুমি সুবিন্যস্ত ও স্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াত করাে (সুরা মুযযাম্মিল: ০৪)।

এজন্য কুরআনের যথাযথ তিলাওয়াত অনিবার্য। কেননা, আনাস ইবনে মালিক (রা) হতে বর্ণিত - "এমন অনেক কুরআন পাঠক আছে, যারা কুরআন তিলাওয়াত করে আর কুরআন তাদের অভিশাপ দেয়" (ইমাম গাযযালির ইহয়ায়ে উলুমুদ্দীন)

তিনি আরও বলেন, "যে ব্যক্তি সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করে না, সে আমার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়" (সুনানে আবু দাউদ)

কাজেই নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা এবং শুদ্ধ তিলাওয়াতের প্রচেষ্টা চালানাে জরুরি। কুরআনের সাধারণ তিলাওয়াতের পাশাপাশি তা মুখস্থ করার ব্যাপারেও নবি (স) গুরুত্ব দিয়েছেন। এজন্য তিনি
কুরআনহীন মানুষের মনকে শূন্য ঘরের সাথে তুলনা করে বলেছেন - "যে অন্তরে কুরআন মাজিদের কোনাে অংশ নেই নিশ্চয়ই তা একটি শূন্য ঘরের মতাে (মিশকাত)।

সুতরাং প্রতিটি মুসলিম কুরআন তিলাওয়াত করবে, মুখস্থ করবে এবং তার মর্ম অনুধাবন করে বাস্তবজীবনে তাকে রূপায়িত করে তুলবে। তাহলেই তার জীবনে আসবে পার্থিব শান্তি ও মুক্তি।



তথ্যসূত্র:

বই: ইসলাম শিক্ষা - দ্বিতীয় পত্র
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণী
-----------------------------------
ড. এ আর এম আলী হায়দার
ড. মোঃ রেজাউল করিম
ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল
ড. মুহাম্মদ আল আমীন

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন