দর্শনশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান

দর্শনশাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান - বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet

জীবন ও জগতের প্রকৃত সত্য উদঘাটনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার নাম দর্শন। কুরআন মাজিদ থেকে এ দর্শন উৎপত্তি লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসুল (স)-এর উৎসাহে মুসলিম চিন্তাবিদগণ মুক্ত ও নির্মোহ দর্শন আলােচনায় আত্মনিয়ােগ করেন। ফলে খারেজি, শিয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া, কাদারিয়া, মুতাজিলা, আশআরী, সুফি প্রভৃতি ধর্মতাত্ত্বিক-দার্শনিক মতবাদসমূহ জন্মলাভ করে। এ সব মতবাদ বিশ্বদর্শনকে, দর্শনশাস্ত্রকে দারুণ প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করে। মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আলী বিন আবু তালিব (রা), হাসান বসরী, ওয়াসিল বিন আতা, আবুল হুদায়েল আল্লাফ, আল-জুবাই, যামাকশারী, আবুল হাসান আল-আশআরী, আল-বাকিল্লানী, জুওয়াইনী, শাহরাস্তানী, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী, আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, ইবনে সীনা, ইমাম গাযযালী, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন ও আল্লামা ইকবাল প্রমুখ। 
 

আল কিন্দি (৮১৩-৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ)

আবু ইউসুফ ইয়াকুব বিন ইসহাক আল কিন্দি তার যুগের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ছিলেন। তিনি বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক, পারসিক ও অন্যান্য সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশােনা করেন। অধ্যয়ন শেষে আল-কিন্দি গ্রিক দর্শন অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি আব্বাসীয় খলিফাদের অনুবাদ কর্মকর্তা হিসেবে 'এরিস্টটলের ধর্মতত্ত্ব' (Theology of Aristotle) আরবিতে অনুবাদ করেন। তাকে 'আরব জাতির দার্শনিক' বলা হয়। তিনি 'ফালাসিফা গােষ্ঠীর প্রবর্তক। দর্শনশাস্ত্রে তার শ্রেষ্ঠ অবদান On the Intellect,On the five Essences, Analytica, Categories, Apology of Aristotle, Almagistia of Ptolemy,The Elements of Euclid, History of Aristotle প্রভৃতি। দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, চক্ষুবিজ্ঞান ও সংগীতের ওপর আল-কিন্দির ২৬১ খানা গ্রন্থের কথা জানা যায়।  

আল-ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

আবু নসর মুহাম্মাদ আল ফারাবী ছিলেন আল-কিন্দি প্রতিষ্ঠিত ফালাসিফা গােষ্ঠীর শ্রেষ্ঠতম মৌলিক চিন্তাবিদ। তিনি দর্শনচর্চা ও জ্ঞানসাধনায় জীবন উৎসর্গ করেন। যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনে তার অসাধারণ দখল ছিল। তিনি এরিস্টটলের দর্শনের সাথে প্লেটোর দর্শনের সমন্বয় ঘটান এবং এরিস্টটলের ওপর প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ রচনা করেন। যুক্তিবিদ্যা ও এরিস্টটলের দর্শনে বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে 'দ্বিতীয় এরিস্টটল' এবং 'আল-মুআল্লিমুস সানি বা দ্বিতীয় শিক্ষক বলা হয়। দর্শনে আল-ফারাবীর শ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর শতাধিক মহামূল্যবান গ্রন্থ। এর প্রায় অর্ধেকই গ্রিক দার্শনিকদের রচনার টীকা ও সমালােচনা গ্রন্থ। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ইবারা, মাঘালিত, জাদল, খাতাবা, মাকুলাত, বুরহান, কিয়াস, আল-শের, তাফসির, দি ইসাগােপ অব পরফিরি অন্যতম।

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দ)

চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হলেও আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা ছিলেন বিশ্বমানের দার্শনিক। তিনি ধর্ম ও দর্শনকে আলাদা করে দেখান এবং প্রমাণ করেন দর্শন কেবল তাত্ত্বিক আলােচনা নয় বরং এটির প্রায়ােগিক মূল্যও আছে। আল-কিন্দি ও আল-ফারাবী ইসলামি শিক্ষার সাথে এরিস্টটলীয় দর্শনের সমন্বয় সাধনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইবনে সিনা তাতে পূর্ণতা দান করেন। তিনি এ দর্শনের সাথে নব্য প্লেটোবাদী দর্শনের সমন্বয়সাধন করে এক নতুন দার্শনিক ধারার সূচনা করেন। কিতাব 'আশ-শিফা' তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি মোট চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা: যুক্তিবিদ্যা (Logic), প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (Natural Sciences), গণিত (Mathematics) এবং অধিবিদ্যা (Metaphysics)। এ গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে ইবনে সিনা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ও মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দি, আল ফারাবি ও আল-বিরুনিকে অনুসরণ করেন। এছাড়াও তার দর্শনগ্রন্থের মধ্যে উয়ূন আল হিকমাহ, দানেশ নামা, কিতাবুল ইনসাফা, হিকমাতি মাশারিফিয়া প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।

আরও পড়ুনঃ

ইমাম-গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিষ্টাব্দ)

মুসলিম দর্শনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হলেন ইমাম আবু হামিদ মুহাম্মদ বিন আলী আল-গাযযালি। মুসলিম ধর্মতত্ব ও দর্শনে এবং সুফিবাদে তার অবিস্মরণীয় অবদান তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি ধর্মান্ধতার অপসারণ করেন। আল্লাহভীতির পুনঃপ্রবর্তন করেন। তার চেষ্টায় সুফিবাদ ইসলামের অভিন্ন মতবাদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। দর্শনে আল-গাযযালীর শ্রেষ্ঠ অবদান তাঁর অমর গ্রন্থরাজি। তিনি দুশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে ইহইয়া উল উলুম আদুদীন', আল-মানকাব মিনাদ দালাল, তুহফাতুল ফালাসিফা, কিমিআয়ে সা'আদাত, মাকাসিদুল ফালাসিফা, মিনহাজুল আবেদীন প্রভৃতি অন্যতম। 

ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ)

অনারব মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে আবু ওয়ালিদ মুহাম্মাদ বিন আহমদ ইবনে রুশদ অন্যতম। ইবনে রুশদ এরিস্টটলীয় দর্শনের মূলত্ত্ব খুঁজে বের করার প্রয়াস পান এবং এ দর্শনের সাথে ইসলামি চিন্তার সামঞ্জস্য ও সমন্বয়বিধান করেন। তিনি প্রত্যাদেশ ও প্রজ্ঞা উভয়কেই সত্য আখ্যা দেন এবং ধর্ম ও দর্শনকে অভিন্ন বিষয় মনে করেন। তাহাফাতুত তাহাফা, কিতাবুল ফালাসিফা, ফাসলুল মাকালী ফি মুওয়াফিকাতিল হিকমাহ ওয়াশ শরিয়া, কিতাবুল কাশাফান, কিতাবু ফি হারকাত আলআফ প্রভৃতি তার কালােত্তীর্ণ দর্শনগ্রন্থ।

ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ)

ওয়ালিউদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে খালদুন মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজত্ত্ববিদ-ঐতিহাসিক দার্শনিক। তার জ্ঞানদর্শন, ইতিহাসদর্শন, শিক্ষা ও রাষ্ট্রদর্শন তাকে কালােক্তীর্ণ মুসলিম চিন্তাবিদে পরিণত করেছে। তিনি ইতিহাসকে জ্ঞানের অন্যতম উৎস প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং তা একটি বিজ্ঞান ও দর্শনের অংশ। ইবনে খালদুন শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়ােগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করেন। 'আল-মুকাদ্দিমা' তার রচিত বিখ্যাত বই। তার এই গ্রন্থের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল সপ্তম শতকের উসমানীয় খলিফাদের ওপর।

আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)

আল্লামা ড. মুহাম্মদ ইকবাল এক বিস্ময়কর দার্শনিক প্রতিভা। বিগত সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠতম চিন্তাবিদ তিনি। একই সাথে তিনি ছিলেন সাধক, দার্শনিক, কবি, ভাষাশিল্পী, শিল্পসমালােচক, আইনবিদ, রাজনীতিক ও শিক্ষাবিদ। বিগত দিনের সকল বিখ্যাত চিন্তাবিদদের অনুসৃত পথের বাইরে তার পরিক্রমা একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মৌলিক পথে। তিনি দেখিয়েছেন, সংসার থেকে পালিয়ে নয় বরং জীবনসংগ্রামেই আত্মা মােহমুক্ত হয়। ইকবাল মানবব্যক্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এর চরমউ ন্নতিবিধানকেই চূড়ান্ত সাফল্য মনে করেন। এ চিন্তাধারার আলােকে তিনি তার বিখ্যাত খুদী তত্ত্ব' পেশ করেন। আসরার ই-খুদী, পায়াম-ই-মাশরিক, জাবিদ নামা, রুমুজ-ই-বেখুদী, যবুর-ই-আযম প্রভৃতি তার শ্রেষ্ঠ দর্শন কাব্য। বস্তুত এ সহস্রাব্দে তার মতাে করে আর কেউ চিন্তাজগতে এমন ব্যাপক আলোড়ন তুলতে পারেননি।

তথ্যসুত্র : বই - ইসলাম শিক্ষা। 
লেখক: ড. এ আর এম আলী হায়দার।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন