শের শাহ সুরি - Sher Shah Suri

শের শাহ সুরি - Sher Shah Suri - Bongo Tweet
ছবি: © Study IQ education

প্রাথমিক জীবন ও সিংহাসন লাভ 

ধূলাবালির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও যারা নিজেদের প্রতিভা বলে, কলাকৌশলে এবং তরবারির জোরে গৌরবের শীর্ষ শিখরে আরােহণ করে ইতিহাসে পুষ্পের ন্যায় বিকশিত হয়েছেন, ইতিহাসের সে সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে শের শাহ ছিলেন অন্যতম। কোনাে রাজা-বাদশাহর ঘরে কিংবা কোনাে উচ্চ ধর্মীয় অথবা সামরিক নেতার ঘরে জন্মগ্রহণ করার মতাে গৌরবের অধিকারী তিনি ছিলেন না। আর. সি. মজুমদার বলেন, “শের খান শূরের জীবন বাবুরের জীবনের ন্যায় মনােমুগ্ধকর এবং মুঘলশ্রেষ্ঠ আকবর অপেক্ষা কোনাে অংশে কম শিক্ষণীয় নয়।” শের শাহ ছিলেন জাতিতে পাঠান, বংশে শূর এবং জন্মে হিন্দুস্থানী। ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের ধারাবাহিকতার মাঝে একটি যতিচিহ্ন হলাে শের শাহ তথা তুর্কি-আফগানদের স্বল্পকালীন শাসনকাল। 

ব্যাঘ্র পুরুষ শের শাহের বাল্য নাম ছিল ফরিদ। পিতার নাম ছিল হাসান। ফরিদের পূর্বপুরুষগণ আফগানিস্তানের অন্তর্গত তখত-ই-সুলায়মান পর্বতের পাদদেশের শূর গড়াই নামক স্থানের অধিবাসী ছিলেন বলে ভারতবর্ষে তার প্রতিষ্ঠিত বংশ শূরবংশ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বাহলুল লােদীর শাসনামলে ফরিদের পিতামহ ইব্রাহিম ভারতবর্ষে আগমন করে জামাল খান নামক বাহলুল লােদীর জনৈক কর্মচারীর শরণাপন্ন হলে তিনি ইব্রাহিমকে সপরিবারে দিল্লীর অন্তর্গত নারনল অঞ্চলে বসবাস করার অনুমতি প্রদান করেন। সম্ভবত তথায় ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে ফরিদের জন্ম হয় (ঈশ্বরীপ্রসাদ ও কানুনগাের মতে তার জন্মের বছর ছিল ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ)। জামাল খান হাসানের যােগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বিহারের অন্তর্গত সাসারাম ও খাওয়াসপুরের জায়গীর পরিচালনার ভার অর্পণ করেন। 

হাসানের চার স্ত্রী এবং আট পুত্র ছিল। স্বাভাবিকভাবে পিতার ঔদাসীন্য ও বিমাতার দুর্ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়ে ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফরিদ সাসারাম পরিত্যাগ করে জৌনপুরে চলে যান এবং সেখানে বিদ্যাশিক্ষায় মনােনিবেশ করেন। অসাধারণ মেধা ও প্রখর স্মৃতি- শক্তির অধিকারী ফরিদ অতি অল্পদিনের মধ্যেই আরবি ও ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ইতিমধ্যেই তিনি সাদীর গুলিস্তা, বুস্ত ও নিজামীর সিকান্দারনামা কণ্ঠস্থ করে ফেলেন এবং অন্যান্য সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ, বীর গাথা, ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। 

ফরিদের তীক্ষবুদ্ধি ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে হাসানের পৃষ্ঠপােষক জামাল খান তাঁর প্রতি সদয় ব্যবহার করতে হাসানকে নির্দেশ দিলে তিনি পুত্রকে সাসারামের জায়গীর পরিচালনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ফরিদ সাসারাম ও সম্রাট শের শাহ খাওয়াসপুরে শাসনকার্যের বিশেষ করে কৃষিকার্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। ফরিদের ক্রমবর্ধমান যশ-খ্যাতি বিমাতার হৃদয়কে কণ্টকের ন্যায় বিদ্ধ করতে থাকলে আবার বিমাতার দুরভিসন্ধির ফলে পিতৃজায়গীর হতে বঞ্চিত হয়ে ফরিদ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে ভাগ্যান্বেষণে আগ্রায় উপস্থিত হন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যু হলে ইব্রাহিম লােদীর নিকট হতে তিনি পিতার জায়গীর লাভ করেন। কিন্তু ঈর্ষান্বিত বৈমাত্রেয় ভ্রাতা সােলায়মানের বিরুদ্ধাচরণের ফলে তিনি পুনরায় সাসারাম ত্যাগ করে বিহারের স্বাধীন সুলতান বাহার খাঁন লােহানীর অধীনে ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৫২২ হতে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরিদ বাহার খানের অধীনে থেকে শাসনকার্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। এ সময় একদিন তিনি সুলতানের সাথে শিকারে গমন করে নিজ হাতে একটি ব্যাঘ্র হত্যা করে সুলতান কর্তৃক ‘শের খান উপাধিতে ভূষিত হন। বাহার খান শের খানের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতায় বিমুগ্ধ হয়ে তাকে প্রথমে স্বীয় পুত্র জালাল খানের শিক্ষক এবং পরে বিহারের উপ-প্রশাসকের পদে নিযুক্ত করেন। 

ইতিমধ্যে বাহার খানের সাথে মতানৈক্য ঘটলে শের খান তার চাকরিতে ইস্তফা প্রদান করে ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মুঘল বাদশাহ বাবুরের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে চান্দেরী দুর্গ বিজয়কালে বাবুরকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য প্রদান করে পুরস্কারস্বরূপ শের খান বাবুর কর্তৃক পিতার জায়গীরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। অতঃপর শের খান মুঘল রাজসভা পরিত্যাগ করে দক্ষিণ বিহারে গমন করে মৃত বাহার খান লােহানীর পুত্র জালাল খানের অভিভাবক নিযুক্ত হন। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে নাবালক জালাল খানের মাতা দুদু বিবি মৃত্যমুখে পতিত হলে শের খান বিহারের প্রকৃত শাসনকর্তার পদে অধিষ্ঠিত হন। অতঃপর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে শের খান বারানসীর নিকটবর্তী চুনার দুর্গের অধিপতি তাজ খানের বিধবা পত্নী লাদ মালিকাকে বিবাহ করে প্রচুর ধন-সম্পদ প্রাপ্ত হন এবং চুনার দুর্গটিরও মালিক হন। অতঃপর মুঘল সম্রাট হুমায়ুন তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে তিনি মৌখিকভাবে সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং সম্রাটকে পাঁচশত আফগান সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হন। এতে হুমায়ুন দুর্গটিকে শের খানের অধীনে রাখতে সম্মত হন। ইতিমধ্যে শের খানের উত্তরােত্তর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিহারের অভিজাতবর্গ ও জালাল খান শংকিত হয়ে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের সাহায্যে শের খানকে দমন করার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শের খান অতি সহজেই বাংলা ও বিহারের সম্মিলিত সেনাবাহিনীকে মুঙ্গেরের নিকটবর্তী কিউল নদীর তীরে অবস্থিত সুরজগড়ের যুদ্ধে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন (মার্চ , ১৫৩৪ খ্রি.)। ড. কানুনগাে বলেন, “সুরজগড়ের যুদ্ধে জয়লাভ না করলে সাসারামের জায়গীরদার তার নগণ্যতা হতে কখনই হিন্দুস্থানের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করতে পারতেন না।” এই যুদ্ধের ফলে শের খান সমগ্র বিহারের ওপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে শের খান বাংলার শাসনকর্তা মাহমুদ শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে মাহমুদ শাহ তের লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা এবং কিউল হতে সকরিগলি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি শের খানকে সমর্পণ করে সন্ধি স্বাক্ষর করেন। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে শের খান দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ আক্রমণ করে তার রাজধানী গৌড় অধিকার করেন। এই সংবাদ শ্রবণে কালবিলম্ব না করে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন পথিমধ্যে চুনার দুর্গ অধিকার করে গৌড় আক্রমণ করেন। সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর না হয়ে শের খান বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং বারানসী, রােটাস ও জৌনপুর অধিকার করে কনৌজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। প্রায় নয় মাস কাল আমােদ-প্রমােদে বাংলাদেশে অবস্থান করে হুমায়ুন মূল্যবান সময় নষ্ট করলে শের খান সেই সুযােগে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করে হুমায়ুন আগ্রার পথে যাত্রা করলে বক্সারের নিকট চৌসা নামক স্থানে শের খানের হতে শশাচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন (২৬শে জুন, ১৫৩৯ খ্রি.)। হুমায়ুন উপায়ান্তর না দেখে গঙ্গার জলে ঝাপ দিলে ভাগ্যক্রমে নিজাম নামক জনৈক ভিস্তিওয়ালার সাহায্যে কোনােভাবে প্রাণে রক্ষা পান। চৌসার যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কানুনগাে বলেন, “শের খান জৌনপুর, বিহার ও বাংলাদেশে কর্তৃত্ব স্থাপন করে মুঘল সম্রাটের সমকক্ষ হয়ে ওঠেন।" শের খান ‘শের শাহ’ উপাধি ধারণ করেন। কানুনগাে আরও বলেন, “১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের খান একজন সাধারণ মুঘল সামন্ত হিসেবেই সন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু চৌসার যুদ্ধে বিজয় তার আকাঙ্ক্ষাকে সুদূরপ্রসারিত করে।” এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে শের শাহ পশ্চিমে কনৌজ হতে পূর্বে আসাম ও চট্টগ্রাম, উত্তরে হিমালয় হতে দক্ষিণে ঝারখণ্ড এবং বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এক বিশাল বিস্তৃত ভূখণ্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হন। অতঃপর তিনি স্বীয় নামে মুদ্রা অঙ্কন এবং খুতবা পাঠের নির্দেশ জারি করেন।

১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে ৪০,০০০ সৈন্যসহ হুমায়ুন আবার শের শাহের মাত্র ১৫,০০০ বাহিনীর নিকট কনৌজ বা বিলগ্রামের যুদ্ধে মােকাবিলা করতে যেয়ে পরাজিত হন। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে শূর বংশের সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর রাজ্য ও সিংহাসন হারিয়ে হুমায়ুন সুদীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে প্রবাস জীবন যাপন করবার পর পারস্যে গমন করেন এবং তৎকালীন সাফাভী বংশের শাসক শাহ তাহমাসপের সাহায্যে শের শাহের দুর্বল উত্তরাধিকারিগণের নিকট হতে আবার ভারতের সিংহাসন ও রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। হুমায়ুনের পরাজয় ও পতন দর্শনে একজন ঐতিহাসিক বলেন, “এরূপে ভারতে বাবুরের কৃতকর্মের পরিসমাপ্তি ঘটান হয় এবং হিন্দুস্থানের সার্বভৌম ক্ষমতা আরও একবার আফগানদের হস্তগত হয়।” 

হুমায়ুনের ভ্রাতৃগণের ও আত্মীয়-স্বজনের বিরােধিতা ও মুসলিম ইতিহাসে সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব, হুমায়ুনের অদক্ষ সেনাবাহিনী ও সামরিক দূরদর্শিতার অভাব, হুমায়ুনের শের শাহ অপেক্ষা ব্যক্তিগত অযােগ্যতা এবং সর্বোপরি অতিরিক্ত অহিফেন সেবন তার সর্বনাশ ডেকে এনেছিল।


শের শাহের অপরাপর বিজয়সমূহ 

হুমায়ুনের পরাজয় ও পলায়নের পর বঙ্গ, বিহার, দিল্লী, আগ্রা ও জৌনপুরে স্বীয় কর্তৃত্ব স্থাপন করে শের শাহ রাজ্য জয়ে আত্মনিয়ােগ করেন। 

প্রথমে শের শাহ পাঞ্জাব, সিন্ধুদেশ ও মুলতান অধিকার করেন। পাঞ্জাবে তিনি একটি সুদৃঢ় দুর্গ (রােটাস) নির্মাণ করেন এবং গাক্কার উপজাতিকে দমন করবার জন্য তিনি তথায় সুদক্ষ সেনাপতিসহ ৫০,০০০ সৈন্য মােতায়েন রাখেন।

১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিদ্রোহী শাসনকর্তা খিজির খানকে দমন করে শের শাহ বাংলার শাসনকর্তার পদ লােপ করে প্রদেশটিকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক সরকারের শাসনভার একজন ‘কাজী ফজলের’ (বা আমীনের) ওপর ন্যস্ত করেন। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও সংহতির প্রয়ােজনে ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে শের শাহ মালব বিজয় সম্পন্ন করেন। অতঃপর রাজপুতনা অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে শের শাহ পুরনমলকে পরাজিত করে রাইসিন দুর্গ অধিকার করেন। ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েও শের শাহ যােধপুরের মালদেবকে পরাজিত করে মাড়ওয়ার দখল করেন। শের শাহ বলেন, 'এক মুষ্টি বজরার জন্য আমি দিল্লীর সিংহাসন হারাতে বসেছিলাম'। তার সর্বশেষ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল কালিঞ্জর দুর্গের বিরুদ্ধে। এক বছর অবরােধের পর তিনি দুর্গটি অধিকার করেন। কিন্তু ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মে অস্ত্রাগার পরিদর্শনকালে অতর্কিত বারুদ বিস্ফোরণের ফলে শের শাহ মৃত্যুমুখে পতিত হন।  


শের শাহের রাজপুত নীতি 

ঐতিহাসিক কানুনগাের মতে, সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় রাজপুতনা অঞ্চলে শের শাহ সাম্রাজ্যভুক্তকরণ নীতি অবলম্বন করেন নি। তিনি রাজপুতবর্গের ওপর স্বীয় আধিপত্য কায়েম করে যাতে তারা সমবেতভাবে বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করতে না পারে সেজন্য রাজনৈতিক ও ভৌগােলিক দিক দিয়ে তাদেরকে পরপর হতে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন। এ নীতিকে সজীব রাখার উদ্দেশ্যে তিনি আজমীর, চিতাের, যােধপুর এবং মাউন্ট আবুকে সুরক্ষিত করে আফগান সৈন্য মােতায়েন করেছিলেন। ইংরেজ শাসকগণ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন, রাজপুতনার ক্ষেত্রেও শের শাহ অনুরূপ নীতি অবলম্বন করেছিলেন। 


শের শাহের শাসনব্যবস্থা 

ধূমকেতুর ন্যায় অতি স্বল্পকালের জন্য ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে শের শাহ যে সর্বতােমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই বিরল। কেবল সাহসী বীর, সুদক্ষ সেনাপতি, সমরবিজয়ী নেতা এবং মুঘল রাজত্বের অন্তর্বর্তীকালীন আফগান-শূর বংশের স্থাপয়িতা হিসেবেই শের শাহ অক্ষয় কীর্তি রেখে যাননি, সুদক্ষ দূরদর্শী এবং ন্যায়নিষ্ঠ শাসন সংস্কারক হিসেবেও তার নাম ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। শের শাহের চরিত্রে সামরিক প্রতিভার সাথে শাসন দক্ষতার যে অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। “তিনি এমন একটি শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন যা পরবর্তীকালে আকবর কর্তৃক পরিবর্ধিত হয়েছিল। তাকে সঠিকভাবে আকবরের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।” “স্বয়ং আকবর অপেক্ষা শের শাহের প্রশাসনিক মেধা ছিল অধিক।” ভারতের প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় হিন্দু ও মুসলিম শাসন-পদ্ধতির কিংবা আলাউদ্দিন খলজীর শাসন-পদ্ধতির কতকগুলাে মূলনীতি গ্রহণ করলেও শেরশাহের প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার অধিকাংশই ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন। তার শাসনব্যবস্থার প্রশংসা করতে যেয়ে ইংরাজ ঐতিহাসিক কীনি বলেন, “কোনাে শাসকই—এমনকি ব্রিটিশ সরকারও শাসনকার্যে শের শাহের ন্যায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করেননি।” প্রজাপীড়ন না করে প্রজাদের সুখ-শান্তির ওপরই তিনি (শের শাহ) স্বীয় মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বস্তুত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, প্রজারঞ্জক ও জনহিতৈষী সম্রাটদের মধ্যে শের শাহ ছিলেন অন্যতম। তার শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিল হিন্দু ও মুসলমান অধিবাসিগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। একতার আদর্শের ওপর তার সমগ্র সংক্ষিপ্তকালের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ প্রসঙ্গে ড. কানুনগাে বলেন, “শের শাহ এক নতুন ভারতবর্ষের আদর্শ হিসেবে জাগরূক, যে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান অন্তরে ও কর্মে এক এবং অভিন্ন।” বস্তুত শের শাহই ছিলেন প্রথম শাসক যিনি উদার ভিত্তিতে জনগণের সদিচ্ছার ওপর এক ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। হেগের মতে, “প্রকৃতপক্ষে, দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।”


শের শাহ এর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা

শের শাহের শাসনব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক হলেও স্বেচ্ছাতান্ত্রিক ছিল না—এটি ছিল দক্ষ, প্রগতিশীল ও প্রজাকল্যাণ মূলক। জনকল্যাণ সাধন এবং সাম্রাজ্যের সার্বিক মঙ্গল বিধান করাই ছিল শের শাহের শাসনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ‘শের শাহের সরকার স্বৈরতান্ত্রিক হলেও সুদক্ষ ও আলােকদীপ্ত ছিল। ষােড়শ শতাব্দীর একজন ভারতীয় নরপতি স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনি তার প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও নিষ্ঠা দ্বারা অষ্টাদশ শতাব্দী: ইউরােপীয় বিদগ্ধ স্বৈরতন্ত্রীদের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আলাউদ্দিন খলজীর ন্যায় উলামাদের প্রভাব হতে মুক্ত থেকে স্বকীয় বিচার-বিবেক দ্বারা জনগণের উন্নতিকল্পে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় শাসনকার্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস ছিলেন স্বয়ং শের শাহ। তবে সুচারুরূপে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তিনি ৪ জন মন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। যথা : 

(১) দিওয়ান-ই-ওজারাত, 
(২) দিওয়ান-ই-আরজ , 
(৩) দিওয়ান-ই-রিসালত এবং 
(৪) দিওয়ান-ই-ইনশা। 

দিওয়ান-ই-ওজারাতের প্রধান ছিলেন ওয়াজীর। এ বিভাগ অর্থদপ্তরের কাজ করত। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় নিরূপণ করাই ছিল এই দপ্তরের প্রধান কাজ। ওয়াজীর অন্যান্য বিভাগের কার্যাদিও তদারক করতেন। দিওয়ান-ই-আরজ বিভাগের প্রধান ছিলেন আরজ-ই-মামালিক। তিনি সেনাবাহিনীর সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ট্রেনিং দানের কার্যে নিয়ােজিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর বেতন প্রদানের ভারও তার ওপর ন্যস্ত ছিল। দিওয়ান-ই-রিসালত একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রদূতদের সাথে সংযােগ রক্ষা করা, কূটনৈতিক ও অন্যান্য যােগাযােগ রক্ষা করা এবং রাজকীয় দান-খয়রাত পরিচালনা করার দায়িত্বে তিনি নিয়ােজিত থাকতেন। দিওয়ান-ই-ইনশা বিভাগের দায়িত্বে নিয়ােজিত মন্ত্রী রাজকীয় ফরমান তৈরি ও জারি করার, প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সাথে যােগাযােগ বজায় রাখার, দলিল-দস্তাবেজ রক্ষা করার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সম্পন্ন করতেন। এতদ্ব্যতীত কাজী-উল-কুজ্জাত (প্রধান বিচারপতি), মীর-ই-আতিশ (সমর বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা) এবং সদর-উস্-সুদুর (ধর্মীয় বিভাগের প্রধান) এবং মুহতাসিব (নৈতিক বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক ও বাজার পরিদর্শক) এই ৪ জন ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ অফিসার। শ্রীরাম শর্মার মতে, মােট ৮ জন রাজকর্মচারির সমন্বয়ে শের শাহের কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এবং সমগ্র দেশের শাসনকার্য শের শাহ স্বয়ং পরিচালনা, পর্যালােচনা, পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন করতেন।


শের শাহের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা 

শুধু শাসনকার্য পরিচালনার জন্য শের শাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে বিভক্ত করেন। তিনি প্রত্যেক সরকারকে কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করেন। ঐতিহাসিক আব্বাস শেরওয়ানীর মতে শের শাহের সাম্রাজ্যে মোট ১,১৩,০০০ পরগণা ছিল। তার শাসনামলে গ্রাম ছিল সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম শাসন ইউনিট। প্রত্যেক সরকারে শিকদার-ই-শিকদারান ও মুনসীফ-ই-মুনসিফান নামক দুজন সর্বোচ্চ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের ওপর সরকারের অধীনে পরগণাগুলাের শাসনকার্য পরিদর্শনের ভার ছিল। প্রত্যেক পরগণায় একজন শিকদার, আমীন, মুন্সীফ, কোষাধ্যক্ষ এবং হিন্দী ও ফারসি ভাষায় দুজন কারকুন বা হিসাব লেখক ছিলেন। এতদ্ব্যতীত রাষ্ট্র ও প্রজাবর্গের মধ্যে সংযােগ রক্ষার প্রয়ােজনে পাটওয়ারী, চৌধুরী ও মুকাদ্দাম নামক কর্মচারীবৃন্দকেও শের শাহ নিযুক্ত করতেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি শাসনকার্যের খুঁটিনাটি পরিদর্শন করতেন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি ৩ বছরের অধিককাল কোনাে কর্মচারীকে একই স্থানে রাখতেন না। বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে শের শাহ সরকার ও পরগণার শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করতেন না। স্থানীয় পঞ্চায়েতগণ গ্রামবাসীদের সহায়তায় পল্লীর শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। 


শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থা 

শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থা জনহিতৈষী, উদার, বিজ্ঞানসম্মত এবং যুক্তিযুক্ত নীতির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থা তার মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এটা তাকে অমরত্ব দান করেছে। 

তিনি সর্বপ্রথম সাম্রাজ্যের সমস্ত আবাদী জমির নির্ভুল জরিপের ব্যবস্থা করেন এবং জমির উৎপাদিকা শক্তির তারতম্য অনুসারে উৎপন্ন শস্যের ৩ ভাগের ১ হতে ৪ ভাগের ১ অংশ রাজস্ব ধার্য করেন। চৌধুরী, মুকাদ্দাম, পাটওয়ারী প্রভৃতি কর্মচারি নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে রাজস্ব আদায় করতেন। প্রজাগণ রাজকোষেও সরাসরি রাজস্ব জমা দিতে পারত। অতিরিক্ত কর প্রথার বিলােপ সাধন এবং জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ সাধনপূর্বক শের শাহ রায়তওয়ারী প্রথার প্রবর্তন করে প্রজাগণের সাথে সরকারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করেন। প্রজাগণ তাদের দায়িত্ব ও অধিকার বর্ণনা করে কবুলিয়ত সম্পাদন করে দিত, অপর পক্ষে সরকার জমির উপর কৃষকের স্বত্ব স্বীকার করে পাট্টা প্রদান করতেন। রাজস্ব নির্ধারণের ব্যাপারে উদার নীতি গ্রহণ করা হতাে; কিন্তু রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে কঠোরতা প্রদর্শন করা হতাে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে প্রজাদের রাজস্ব মওকুফ করা হতাে এবং প্রয়ােজনবােধে কৃষকদের সরকারি ঋণ দেয়ারও ব্যবস্থা ছিল। 

শের শাহের ভূমি প্রশাসন ও রাজস্ব নীতির ফলে একদিকে যেমন সরকারি আয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে কৃষকেরাও এ দ্বারা দারুণভাবে উপৃকত হয়। তার এ রাজস্বনীতি উপমহাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। মোরল্যাণ্ড বলেন, “শের শাহের রাজস্ব ব্যবস্থার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এই যে, আকবরের শাসনকালের প্রথমার্ধে শাসনব্যবস্থার যে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় তা ছিল সে সবের আরম্ভ বিন্দু।” সম্রাট আকবরের আমলে ‘টোডরমল বন্দোবস্ত’ ও ইংরেজদের ‘রাওতওয়ারী বন্দোবস্ত’ বহুলাংশে শের শাহের রাজনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। কাজেই শের শাহের রাজস্ব নীতির প্রভাব শুধু মুঘল যুগেই নয়, ব্রিটিশ আমলেও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। 


শের শাহের সামরিক সংস্কার 

মাত্র ৫ বছরের রাজত্বকালে হুমায়ুনকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসনের ওপর ও সমগ্র উত্তর ভারত এবং রাজপুতনার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সামরিক বাহিনীর সংগঠন ও সংস্কার সাধনে শের শাহ অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করে গিয়েছেন। 

প্রথমত, সামন্ত প্রথার উচ্ছেদ সাধন করে সেনাবাহিনীর সাথে তিনি প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সামরিক বিভাগ প্রত্যক্ষভাবে তার কর্তৃত্বাধীনে ছিল।

দ্বিতীয়ত, আলাউদ্দিন খলজীর অনুকরণে সেনাবাহিনীতে তিনি দাগ (অশ্ব চিহ্নিতকরণ) এবং চেরা (সৈন্যদের বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত তালিকা) ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। 

তৃতীয়ত, তিনি জায়গীরের বিলুপ্তি সাধন করে বেতনভােগী সৈন্য পােষণ করতেন, যা আকবরের মনসবদারী প্রথার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। অবশ্য তিনি ফৌজদারদের নেতৃত্বাধীনে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক বাহিনী (ফৌজ) মােতায়েন রাখার ব্যবস্থা করেন। সৈন্যদের জায়গীর না দেয়ার পিছনে সম্ভবত রাজস্ব আয় বৃদ্ধির বিষয়টি জড়িত ছিল। 

চতুর্থত, সামরিক বাহিনীকে শের শাহ প্রতি ২ বছর অন্তর স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা করেন। 

পঞ্চমত, সেনাবাহিনীতে তিনি কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার নীতি প্রবর্তন করে দুর্নীতি প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। শের শাহ ব্যক্তিগত গুণানুসারে সৈন্যদের মান নির্ণয় করেন। 

শের শাহের সেনাবাহিনীতে ২৫,০০০ পদাতিক, ১,৫০,০০০ অশ্বারােহী এবং ৫০০ হস্তীবাহিনী ছিল। পদাতিক বাহিনী বন্দুক ও তীর উভয় প্রকার অস্ত্রই ব্যবহার করত। যুদ্ধ যাত্রাকালে সেনাবাহিনীকে শস্যক্ষেত্র নষ্ট করতে কিংবা অন্য কোনাে প্রকার ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত হতে দেয়া হতাে না। সুশিক্ষিত, সুসজ্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী ছিল শের শাহের শাসন দক্ষতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বস্তুত তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন ও আলাউদ্দিন খলজীর সামরিক ব্যবস্থার উপযােগিতার প্রতি লক্ষ রেখে তাদের অনুকরণে সামরিক সকোর পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। 


শের শাহের বিচার বিভাগ 

ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে শের শাহের সুবিচারের খ্যাতি সর্বজনস্বীকৃত। তার শাসনামলে আইনের চোখে এবং বিচারের ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গােত্র ও ব্যক্তি নির্বিশেষে সকলে সমান ছিল এবং কোনাে প্রকার বৈষম্য রচনা . করা হতাে না। সামন্ততান্ত্রিক যুগেও ন্যায়বিচারের বিস্ময়কর আদর্শস্থাপনকারী স্বয়ং শের শাহ ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারপতি। বিচারালয়কে দার-উল-আদালত বলা হতাে। কেন্দ্রীয় রাজধানীতে কাজী-উল-কুজ্জাতও সদর বিচারকার্যে শের শাহকে সর্বতােভাবে সাহায্য প্রদান করতেন। সরকারের প্রধান বিচারপতি ছিলেন মুনসেফ-ই-মুনসিফান। পরগণায় আমীন দেওয়ানী মােকদ্দমা এবং কাজী ও মীর আদল ফৌজদারী ও অপরাপর মােকদ্দমার বিচার করতেন। পঞ্চায়েতগণ হিন্দুদের ধর্মীয় ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মামলা মােকদ্দমার নিষ্পত্তি করতেন। গ্রাম্য মােড়লদের ওপর গ্রামাঞ্চলের অপরাধ দমন ও নিবারণের ভার ন্যস্ত ছিল। শের শাহের দণ্ডবিধি আইন ছিল অত্যন্ত কঠোর। অপরাধীকে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হতাে। ভি. ডি. মহাজন বলেন, “সুবিচারক হিসেবে শের শাহের এত বেশি সুখ্যাতি ছিল যে একজন বণিক চুরির ভয়ে ভীত না হয়ে নির্বিঘ্নে মরুভূমির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতে এবং তথায় ঘুমাতে পারত।” 


শের শাহের পুলিশ বিভাগ ও গুপ্তচর প্রথা 

ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে শের শাহের পুলিশব্যবস্থা সনাতনী হলেও তা ছিল উন্নত ধরনের ও শক্তিশালী।” সাম্রাজ্যে অব্যাহত শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন বলবৎ রাখার প্রয়ােজনে শের শাহ পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করেন। সরকারে শিকদার-ই-শিকদারান এবং পরগণায় শিকদার চুরি-ডাকাতি প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ নির্মূল করার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। শহরে এবং গ্রামে চুরি-ডাকাতি সংঘটিত হলে যথাক্রমে মােকদ্দামকে ও গ্রাম্য প্রধানকে অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করতে হতাে। অন্যথায় তাদেরকে শাস্তি ভােগ করতে অথবা ক্ষতিপূরণ দিতে হতাে। ফলে স্ব-স্ব এলাকার প্রধানগণ সর্বদা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ থাকতেন। তদুপরি গণচরিত্রকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে শের শাহ মুহতাসিব নামক এক শ্রেণির কর্মচারি নিয়ােগ করতেন। বলবন ও আলাউদ্দিন খলজীর ন্যায় শের শাহ অসংখ্য গুপ্তচর বাহিনী নিযুক্ত করে সরকারি কর্মচারিবৃন্দের গতিবিধি ও সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতেন। এরূপ অবধা অবলম্বনের ফলে নিজামউদ্দিন বলেন, "রাস্তাঘাটে এরূপ নিরাপত্তা বিরাজ করত যে যদি কেউ স্বর্ণমুদ্রায় ভরা থলেসহ রাত্রির পর রাত্রি ধরে মরুভূমিতে ঘুমাত, তা হলেও পাহারার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না।”


শের শাহপর শুল্ক ও মুদ্রানীতি 

সিংহাসনে আরােহণের অব্যবহিত পরে শের শাহ লক্ষ করেন যে—(১) সাম্রাজ্যে ব্যাপক জাল মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে; (২) বিভিন্ন রাজবংশের আমলের মুদ্রারও যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে এবং (৩) বিভিন্ন ধাতুতে নির্মিত মুদ্রার কোনােরূপ নির্ধারিত মূল্যও ছিল না। এ সব অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে শের শাহ এক প্রকার নতুন রৌপ্য মুদ্রা প্রচলন করেন যা পরবর্তীকালে তঙ্কা (টাকা) ও রূপাইয়া নামে সমধিক পরিচিত ছিল। তিনি স্বর্ণমুদ্রারও প্রবর্তন করেন। তায় নির্মিত মুদ্রা সাধারণত ‘দাম' নামে অভিহিত হতাে। তিনি আধুলি, সিকি, দু-আনি ও এক আনি খুচরা মুদ্রারও প্রবর্তন করেন। মুদ্রার ওপর আরবি অক্ষরে সুলতানের নাম, উপাধি, টাকশালের নাম এবং কখনও খলিফার নাম অঙ্কিত থাকত। মােটামুটিভাবে তার মুদ্রা ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ দেশে আদর্শ মুদ্রার মর্যাদা লাভ করেছিল। শের শাহ প্রবর্তিত মুদ্রা ধাতুর বিশুদ্ধতায়, সৌন্দর্যে, অক্ষরের স্পষ্টতায় ও মানের অনুপাতে ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। মুদ্রা জালিয়াতির বিরুদ্ধে তিনি যথােপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড থমাস বলেন, “শের শাহের রাজত্বকাল ভারতীয় মুদ্রা ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সংযােজন করেছে। এর ফলে জনগণের বিনিময় ব্যবস্থা সহজসাধ্য হয়ে ওঠে এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটে। 

শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য শের শাহ আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক উঠিয়ে দেন। তিনি অবাঞ্ছিত শুল্ক কর রহিত করে বিক্রয় কেন্দ্রে অথবা সীমান্তে শুল্ক কর ধার্যের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এক কথায়, শের শাহের শুল্ক ও মুদ্রানীতি সাম্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব প্রগতি ও জনগণের সমৃদ্ধি আনয়ন করে। 

শের শাহের শিক্ষা ও স্থাপত্য ক্ষেত্রে সংস্কার 

শিক্ষাক্ষেত্রে শের শাহ উদার নীতি গ্রহণ করেন। হিন্দুগণ সংস্কৃত ভাষায় সনাতনী পদ্ধতিতে শিক্ষা দান ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে এবং এ ব্যাপারে শের শাহ কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপ করেন নি। মুসলমানদের শিক্ষার জন্য মসজিদ সংলগ্ন মক্তবে আরবি, ফার্সি ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা স্থাপন করেন। মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এবং এমন কি হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শের শাহ ওয়াকফ সম্পত্তি প্রদান করেন। ব্রাউন বলেন, “স্বল্পকালীন শাসন আমলে শের শাহ তার ইমারতগুলােতে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রকট এবং সুস্পষ্ট ছাপ রেখে গিয়েছেন।” রােটাস গড়ের দুর্গ, দিল্লীর পুরানা কিল্লা এবং সাসারামে তার নির্মিত সমাধি সৌধ স্থাপত্য শিল্পে তাঁর অনুরাগের স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর সমাধি সৌধ সম্পর্কে ফারগুসন বলেন—“ভারতবর্ষের চমৎকার ও সুপরিকল্পিত ইমারতগুলাের মধ্যে এটা ছিল অন্যতম।” ধর্মীয় নীতি যদিও শের শাহ ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান তবুও তিনি অন্য ধর্মের প্রতি উদার মনােভাব পােষণ করতেন। তিনি হিন্দুদেরকে রাজকার্যে নিয়ােজিত করতেন। পদাতিক বাহিনীতেও তাদেরকে নিয়ােজিত করতে তিনি দ্বিধাবােধ করতেন না। কানুনগাে বলেন, “হিন্দুদের প্রতি শের শাহ ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করেন। এ ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সশ্রদ্ধ বিনয়ের, অবজ্ঞাসূচক অপছন্দতা নয়।” শ্রীবাস্তবের মতে আকবর অপেক্ষা তাঁর উদার ধর্মনীতি অধিকতর সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু ইতিহাসবেত্তা রাম শর্মা ভিন্ন মত পােষণ করে বলেন, “শের শাহ নিজে গোড়া মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ন্যায়বিচার ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে হিন্দুদের একতাবদ্ধ করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি রাজনীতি হতে ধর্মকে পৃথক করেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির দ্বারা উভয় সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় নীতিতে তিনি অসাম্প্রদায়িক ও সর্বভারতীয় ছিলেন।


শের শাহের সময়ের যাতায়াত ব্যবস্থা

প্রথমত, সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধানকল্পে সেনাবাহিনীর যাতায়াত; দ্বিতীয়ত, জনগণের গমনাগমনের সুবিধার্থে  এবং তৃতীয়ত, ডাক ব্যবস্থার প্রচলন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে শের শাহ সমগ্র সাম্রাজ্যে সুপ্রশস্ত, সুদীর্ঘ এবং সুন্দর রাস্তা নির্মাণ করেন। ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “শের শাহই ছিলেন প্রথম মুসলিম নরপতি,যিনি জনগণের সুবিধার্থে অসংখ্য সড়ক নির্মাণ করেন। তার নির্মিত সড়কগুলাের মধ্যে প্রধান ছিল চারটি। এগুলাে হচ্ছে (১) সড়ক-ই-আযম বা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রােড। এটা বাংলাদেশের সােনারগাঁও হতে সিন্ধু অববাহিকা পর্যন্ত প্রায় পনেরাে শ' ক্রোশ বিস্তৃত ছিল। এটা ছাড়াও (২) লাহাের হতে মুলতান, (৩) আগ্রা হতে বােরহানপুর এবং (৪) আগ্রা হতে যােধপুর ও চিতাের পর্যন্ত সুপ্রশস্ত রাস্তাগুলােও তিনি নির্মাণ করেন। পথিকদের সুবিধার জন্য রাস্তার উভয় পার্শ্বে ছায়াতরু রােপিত হয়েছিল এবং প্রতি ক্রোশ অন্তর একটি করে সরাইখানা স্থাপিত হয়েছিল। সরাইখানাগুলােতেও হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করা ছাড়াও সেগুলােতে কূপ ও মসজিদেরও ব্যবস্থা ছিল। কানুনগাে বলেন, “সড়কের মধ্যবর্তী সরাইখানাগুলাে সাম্রাজ্যের স্তিমিত অঙ্গে প্রাণ সঞ্চারকারী শিরা-উপশিরার কাজ করে।" এগুলােকে কেন্দ্র করে জনবসতি গড়ে ওঠে, দোকান-পাট স্থাপিত হয় এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটে। উক্ত সরাইখানাগুলাে ডাক চৌকির বা ডাকঘরের কাজও করত। এগুলােতে ঘােড়ার ডাকের সাহায্যে এক স্থান হতে অপর স্থানে সরকারি সংবাদ আদান-প্রদান করা হতাে। 

যা হােক, শের শাহ কর্তৃক নির্মিত রাস্তাগুলাে সম্পর্কে ড. কানুনগাে বলেন, “তার নির্মিত রাস্তাগুলােই হচ্ছে অত্যন্ত স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ এবং এগুলাে আজও তার দেশবাসীর মনে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।”  

শের শাহের জনহিতকর কার্যাবলি 

মাত্র ৫ বছরের স্বল্পকালীন রাজত্বকালে শের শাহ অযথা কর আরােপ করে অথবা সেনাবাহিনী কর্তৃক উৎপন্ন শস্য নষ্ট করে প্রজাসাধারণের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেন নি। ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “দয়া-দাক্ষিণ্যের ব্যাপারে শের শাহ মুক্ত হস্তে দান করতেন এবং এগুলাের ব্যবস্থাপনা তিনি ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন।” শের শাহ মনে করতেন সাধু ও সাধক পুরুষদের ওপরই সাম্রাজ্যের সুখ ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে। এ বিশ্বাসে তিনি তাদেরকে নিয়মিত ভাতাদানের ও লাখেরাজ বা নিষ্কর ভূমি দানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তি এবং মসজিদ, মাদ্রাসা এমনকি মন্দিরকেও নিয়মিত মঞ্জুরী প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি দুস্থ ব্যক্তিদের জন্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে লঙ্গরখানা স্থাপন করেন। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি লঙ্গরখানায় বছরে ৮০,০০০ আশরফী ব্যয় করা হতাে। 

পরিশেষে, মহান শের শাহ মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলেই বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের ও জাতির ভারতবাসীকে “ভারতীয় জাতীয়তাবাদের" আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে একটি মহান জাতিতে পরিণত করতে আমরণ সংগ্রাম করে গিয়েছেন। পরবর্তী মহান মুঘল সম্রাট আকবর এই নীতির ধারক ও বাহক ছিলেন এবং একে আরও ব্যাপক করে তুলতে প্রয়াসী ছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত শাসন সংস্কার তার অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে এবং তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে। এ ব্যাপারে তিনি আকবর এবং ব্রিটিশ সরকারের অগ্রদূত ছিলেন। শের শাহ সম্পর্কে যথার্থভাবে বলা যেতে পারে যে— “ইন্দো-মুসলিম ইতিহাসের আকাশে উজ্জ্বল ধূমকেতুর ন্যায় অতি স্বল্প সময়ের জন্য উদিত হয়ে পরবর্তী যুগের জন্য ইন্দো-পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রেই তিনি একটি বিজ্ঞােচিত এবং জনকল্যাণকর শাসন সংস্কার প্রবর্তন করেন।”


শের শাহের চরিত্র ও কৃতিত্ব 

ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “শের শাহকে মধ্যযুগের ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম বলে সঠিকভাবে অভিহিত করা হয়েছে।” শের শাহের কৃতিত্বের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ডক্টর কানুনগাে বলেন, “হিন্দু ও মুসলমানের সৃষ্ট নতুন ভারতের প্রতীক হিসেবে শের শাহ মধ্যযুগের শাসকদের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন।” তার ন্যায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নৃপতির সংখ্যা ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে ছিল খুবই বিরল। তিনি ছিলেন একাধারে অসামান্য যুদ্ধকৌশলী, পারদর্শী। সমরনায়ক, দ্বিধা-বিভক্ত ও হতাশাগ্রস্ত আফগান জাতির সংগঠক, বৈপ্লবিক সংস্কারক এবং প্রজাবৎসল নৃপতি। সামান্য এক জায়গীরদারের পুত্র হয়ে এবং প্রথম জীবনে বিমাতার চক্রান্তে নানা প্রকার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে লালিত-পালিত হয়ে স্বীয় অধ্যবসায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমের বলে ভারতবর্ষে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করে গিয়েছেন। এরস্কাইন বলেন, “নগণ্য জায়গীরদারের পদ হতে স্বীয় মেধা এবং শক্তি বলে শের শাহ দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বহু তাৎপর্যপূর্ণ কার্য দ্বারা নিজেকে উক্ত সিংহাসনের সম্পূর্ণ উপযুক্ত প্রমাণ করেন। ভারতবর্ষের যে কোনাে নৃপতি অপেক্ষা তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। জনগণের প্রতিপালক এবং আইনদাতা হিসেবে একমাত্র আকবর ছাড়া আর কেউই তার সমকক্ষ ছিলেন না।” 

রাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি এ ধারণা পােষণ করতেন যে, “মহান ব্যক্তিকে সর্বদাই কর্মঠ হতে হয়।” ["It behaves the great to be always active."] 

রাজনীতিক হিসেবে : তাঁর চরিত্রে আকর্ষণীয় গুণাবলির অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। স্বয়ং একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়েও তিনি ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু। রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতিকে ধর্মীয় প্রভাব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখেন এবং আলাউদ্দিন খলজী ও মুহম্মদ ঘােরীর ন্যায় নিজেকে কখনও উলামাদের দ্বারা কিংবা ধর্মীয় সংকীর্ণতা দ্বারা আচ্ছন্ন হতে দেন নি। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তা ছাড়া হিন্দু, মুসলিম, তুর্কি, আফগান , খলজী প্রভৃতি সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের সুযােগ্য ব্যক্তিবর্গকে তিনি শাসন কার্যের বিভিন্ন পদমর্যাদায় নিযুক্ত করে এমন একটি মানসিকতার সৃষ্টি করেন যে, বিজিত ও বিজয়ী সকলেই তাদের অতীতের দ্বন্দ্ব-কোলাহল বিস্মৃত হয়ে একটি নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তদুপরি , রাজনৈতিক কারণে এবং সময়ের অভাবে তিনি জিজিয়া কর রহিত কিংবা আন্তঃবিবাহ উৎসাহিত না করলেও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধিবাসিগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে শের শাহই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে এক জাতীয়তাবাদ (One Nationality) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি নতুন দিকের উন্মােচন করেছেন। ভারতবর্ষের সব শ্রেণির জনগণের সহযােগিতা, শুভেচ্ছা ও সম্প্রীতির ভিত্তিতে তিনি জাতীয় সংহতি আনয়ন করতে প্রয়াসী ছিলেন। ঐতিহাসিক কীনি বলেন, সংক্ষিপ্ত শাসনকাল এদেশে একতা আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়ােজিত ছিল। তিনি বহু পূর্বেই অনুধাবন করেছিলেন যে, দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন একতা (ও সংহতি)।” কানুনগাের মতে, ভারতের আদর্শ নরপতি হিসেবে শের শাহ বিরাজমান ছিলেন। কানুনগাে আরও বলেন, “হিন্দু ও মুসলমানের সৃষ্ট নতুন ভারতের প্রতীক হিসেবে শের শাহ মধ্যযুগের শাসকদের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন।” 

যােদ্ধা ও সেনাপতি হিসেবে : সুদক্ষ যােদ্ধা ও অসাধারণ সামরিক প্রতিভাসম্পন্ন শের শাহ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অতুলনীয় বীরত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। মাত্র দুটি যুদ্ধেই হুমায়ুনকে তিনি সিংহাসনচ্যুত ও দেশত্যাগী করতে সক্ষম হন। মালব, বুন্দেলখণ্ড ও রাজপুতনার অভিযান তার সামরিক প্রতিভার শ্রেষ্ঠ স্বাক্ষর বহন করে। যুদ্ধজয়ে তিনি কূট-কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করতে দ্বিধাবােধ করেন নি। শ্রীবাস্তব বলেন, “শের শাহের সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল অত্যন্ত উঁচুদরের।”

শাসক হিসেবে : প্রশাসনিক সংস্কারক হিসেবে ভারতের ইতিহাসে শের শাহ্ আজও অমর হয়ে রয়েছেন। ভারতীয় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনিই। তার প্রবর্তিত বেসামরিক শাসনব্যবস্থা বিশেষ করে রাজস্ব ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তার উদারতা, সহিষ্ণুতা ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ভারতের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়দ্বয়কে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যাতায়াত ব্যবস্থা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতি সাধন, আইনের শাসনের প্রবর্তন, ঘােড়ার ডাকের প্রচলন, সাম্রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা আনয়ন এবং শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের উৎকর্ষ সাধন করে প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে শের শাহ অসামান্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থভাবেই বলেন, “শের শাহ ইতিহাসে একটি উচ্চস্থান লাভের যােগ্য। রাজনৈতিক সংস্কার এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতির প্রবর্তন করে তিনি অজ্ঞাতসারে আকবরের শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি রচনা করেন।” কানুনগাের মতেও, “বিশ্বের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের মধ্যে শের শাহ ছিলেন অন্যতম।” দুস্থদের ভাতাদান, গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান এবং সুফী-সাধকদের মঞ্জুরী বরাদ্দ করে দানশীল ও প্রজাদরদী নৃপতি হিসেবে তিনি ভারতবাসীর মনে আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরিত হয়ে থাকেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থভাবেই বলেন, রাষ্ট্রের জন্যই তিনি বেঁচে ছিলেন এবং তার প্রজাবর্গের কল্যাণ সাধনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।

জাতি গঠনকারী হিসেবে : সামরিক প্রতিভা ও সাহিত্যানুরাগের এক অভূতপূর্ব সমন্বয় তার চরিত্রে পরিলক্ষিত হয়। অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী শের শাহের গুলিস্তা, বােস্তা, সিকান্দরনামা প্রভৃতি গ্রন্থাবলি আদ্যোপান্ত কণ্ঠস্থ ছিল। আরাম-আয়েশ, ভােগবিলাস, শিথিলতা বা গর্হিত অসামাজিক কাজকর্মে মত্ত হওয়ার তার অবসর বা প্রবণতা ছিল না। কর্মই ছিল তার জীবন। ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “প্রকৃতপক্ষে, শেরশাহের কীর্তিসমূহ তাকে মধ্যযুগের ইতিহাসের সম্মুখভাগে আসন দান করেছে।” বহুবিধ ভাগ্যবিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে জীবনের পথে অগ্রসর হয়ে শের শাহ ভারত সম্রাটের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু নিজ অবস্থার এরূপ অভাবনীয় পরিবর্তন তার চরিত্রে কোনাে ঔদ্ধত্যের সৃষ্টি করে নি। এক কথায়, একমাত্র সম্রাট আকবর ভিন্ন অপর কোনাে মুসলমান শাসক শের শাহের ন্যায় বহুবিধ গুণাবলির অধিকারী ছিলেন না এবং জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রজাবর্গের এরূপ সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হন নি। পরিশেষে, স্মিথ বলেন, “যদি শেরশাহ আরও কিছুকাল বেঁচে থাকতেন, তা হলে তিনি তাঁর বংশ প্রতিষ্ঠা করতেন এবং মহান মুঘল সম্রাটগণের ইতিহাসের পাতায় আর আবির্ভাব ঘটত না।”


শের শাহের উত্তরাধিকারী ও মুঘলদের পুনরুত্থান 

শের শাহের মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ ইসলাম শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সাহসী, বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী নরপতি ইসলাম শাহ খাক্কারদের ধ্বংস সাধন করেন। কিন্তু অভিজাতবর্গের প্রতি সুষ্ঠু নীতি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি সাম্রাজ্যে রাজদ্রোহিতার বীজ বপন করেন। নয় বছর (১৫৪৫–৫৪ খ্রি. পর্যন্ত) রাজত্ব করার পর তিনি পরলােকগমন করেন। ইসলাম শাহের পর তার নাবালক পুত্র ফিরােজ সিংহাসনে আরােহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই খুল্লতাত মুবারিজ খাঁ কর্তৃক নিহত হন। এর পর মুবারিজ খাঁ আদিল শাহ (১৫৫৫–৫৬ খ্রি.) উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে উপবেশন করেন। কিন্তু শূর পরিবারভুক্ত ইব্রাহিম খা শূর আদিল শাহকে পরাজিত করে আগ্রা ও দিল্লী অধিকার করেন। আদিল শাহ চুনারে আত্মগােপন করেন। সিকান্দার শাহ নামক অপর একজন আমীর ইব্রাহীমকে বিতাড়িত করে দিল্লী ও আগ্রা অধিকার করেন। অবশেষে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে সিকান্দার শাহকে পরাজিত করে হুমায়ুন দিল্লীর সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। এভাবে শূর বংশের পরিসমাপ্তি ঘটে।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন