Skip to content Skip to sidebar Skip to footer

জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবর - Jahiruddin Muhammad Babar

জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবর - Jahiruddin Muhammad Babar - Bongo Tweet

সম্রাট বাবরের প্রাথমিক জীবন

জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি রােজ শুক্রবার মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তানের ফরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবর তুর্কি শব্দ। এর অর্থ সিংহ (ব্যাঘ্র নয়)। সিংহের ন্যায় তেজ ও সাহসিকতা দ্বারা তিনি বাবর নামের সার্থকতা প্রমাণিত করেন। তাঁর পিতা উমর শেখ মির্জা ছিলেন ইতিহাস বিখ্যাত তৈমুরের বংশধর এবং মাতা কুতলুঘ নিগার খানুম ছিলেন বিশ্বের ত্রাস সৃষ্টিকারী চেঙ্গিস খানের অধস্তন বংশধর ইউনুস খানের কন্যা। এরূপে বাবুরের ধমনীতে পিতা ও মাতা উভয়দিক হতে মধ্য এশিয়ার দুই দুর্ধর্ষ শ্রেষ্ঠ দ্বিগ্বিজয়ী বীরের রক্ত প্রবাহিত। পিতার দিক হতে বাবুর চাগতাই তুর্কি বংশের সাথে জড়িত বলে নিজেকে মােঙ্গল হিসেবে নয়, বরং তুর্কি হিসেবেই পরিচয় দিতেন। শৈশবে বাবুর বিদূষী মাতামহী আয়সন দৌলত বেগম এবং গৃহশিক্ষক শেখ মজিদের নিকট তুর্কি, আরবি ও ফারসি ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। বাবুরের চরিত্র ও মানস গঠনে এবং সাহসী ও আত্মনির্ভরশীল হবার ক্ষেত্রে তাঁর মাতামহীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর বাবর ফরগনার পিতৃ সিংহাসনে আরােহণ করেন। সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি দুই পিতৃব্য ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং সাইবানী খানের ন্যায় ঘােরতর শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন। ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে চাচা আহমদ মির্জার মৃত্যুর পর মাত্র ১০০ দিনের জন্য প্রথমবার এবং ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে কিছুকালের জন্য দ্বিতীয়বার এবং ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বারের জন্য তিনি সমরকন্দ অধিকার করেন। কিন্তু আরচিয়ানের যুদ্ধে সাইবানী খানের নিকট ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত হয়ে তিনি সমরকন্দ হারান এবং পিতৃরাজ্য ফরগনা হতে বিতাড়িত হন। রাজ্যচ্যুত ও গৃহচ্যুত হয়ে বাবর আশ্রয়ের সন্ধানে স্থান হতে স্থানান্তরে ঘুরতে থাকেন।

ভাগ্য-বিড়ম্বিত বাবর ছিলেন স্থির ও নির্ভীক। এ সময় কাবুলের অভ্যন্তরীণ অরাজকতার সুযােগে তিনি ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুল অধিকার করেন এবং ‘বাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কাবুলে রাজত্ব করতে থাকেন। ইতিমধ্যে উজবেক নেতা সাইবানী খান পারস্যের অধিপতি শাহ ইসমাইলের সাথে যুদ্ধ হলে তিনি আবার সমরকন্দ অধিকার করেন। কিন্তু অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস ! শীঘ্রই উজবেকগণের নিকট পরাজিত হয়ে ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমরকন্দ হতে বিতাড়িত হন। মধ্য এশিয়ায় রাজ্য স্থাপন অসম্ভব মনে করে তিনি ভারতের দিকে রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এদিক দিয়ে মুইজউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরীর সাথে তার পূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তার মধ্য এশিয়ায় ব্যর্থতার ফলই হিন্দুস্থান বিজয়। তদুপরি তাঁর ভারত অভিযানের প্রাক্কালে যে পাঁচজন মুসলিম সুলতান ও দুজন হিন্দু রাজা (দিল্লীতে ইব্রাহীম লােদী, গুজরাটে মুজাফফর শাহ, দাক্ষিণাত্যে বাহমনী, মালবে মাহমুদ খলজী, বাংলায় নসরত শাহ এবং দুটি হিন্দুরাজ্য - বিজয়নগর ও চিতাের) রাজত্ব করতেন তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অহি-নকুল সদৃশ। তদুপরি তার পূর্বপুরুষগণ কর্তৃক ইতিপূর্বে ভারতের কতিপয় অঞ্চল বিজয় তাকে ভারত অভিযানে অনুপ্রাণিত করে তােলে। এ প্রসঙ্গে ড. ঈশ্বরীপ্রসাদের মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। “ষােড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতবর্ষ অনেকগুলাে বিবদমান রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যা যে কোনাে শক্তিশালী ও আক্রমণেচ্ছু সেনানায়কের সহজ বিজয়ের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।” ভারতের অগণিত ধনরত্নও বাবরকে ভারত বিজয়ে প্রলুদ্ধ করে। বাবুর তার আত্মচরিতে লিপিবদ্ধ করেছেন— "কাবুল জয় করার পর হতে আমি ভারত জয়ের পরিকল্পনা করছিলাম।” আসন্ন ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে যে, তার এ পরিকল্পনা সঠিক ছিল। 


সম্রাট বাবরের ভারত অভিযান 

ভারত অভিযানের কারণসমূহ : ইতিপূর্বে উল্লেখিত কারণগুলাে ছাড়াও হিন্দুস্থান ও কাবুলের সান্নিধ্য, ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগােলিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, বাবরের অদম্য রাজ্যজয় লিপ্সা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পরিশেষে ভারতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের আমন্ত্রণ বাবুরকে ভারত আক্রমণে প্রলুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে তােলে।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধের পূর্বে বাবুরের ভারত অভিযানসমূহ : উপমহাদেশে মুসলিম সুলতানদের মধ্যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে দুর্বল ভারতবর্ষ বাবরকে রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা কার্যকরী করতে সুযােগ প্রদান করে। চূড়ান্তভাবে ভারতবর্ষে অভিযান পরিচালনা করার পূর্বে বাবর পর্যবেক্ষণমূলক অভিযানে প্রবৃত্ত হন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুনদ অতিক্রম করে তিনি বজৌর দুর্গ, ঝিলাম নদীর তীরস্থ ভেরা প্রভৃতি বিনা বাধায় অধিকার করেন। ঐ সময় তিনি মৌলা মুর্শিদকে তার দূত হিসেবে ইব্রাহীম লােদীর নিকট প্রেরণ করে পূর্বে তুর্কিদের অধিকারে যে সব স্থান ছিল সেগুলাে দাবি করেন। কিন্তু লাহােরের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ উক্ত দূতকে কিছুকাল বন্দী করে রেখে মুক্ত করে দিলে তিনি দিল্লী সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ না করেই প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর বিক্ষুদ্ধ বাবর ১৫২০ সালে বদাখসান এবং ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার অধিকার করে হুমায়ুনকে বদাখসানের এবং কামরানকে কান্দাহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ইব্রাহীম লােদীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লােদী, আলম খান এবং অপরাপর আফগান ওমরাহ বাবরকে ভারতবর্ষ আক্রমণের আহ্বান জানালে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাবুর তার অভিপ্রায় সিদ্ধির সুযােগ লাভ করে ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে লাহাের অধিকার করেন। তারপর বাবুর শিয়ালকোট, দিপালপুর এবং পাঞ্জাবের অন্যান্য স্থান হস্তগত করেন। দৌলত খান লােদী ও আলম খান বাবরের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তার বিরােধিতা শুরু করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে বাবর ভারত জয় পূর্ণোদ্যমে শুরু না করে কাবুলে প্রত্যাবর্তন করেন। 


পানিপথের প্রথম যুদ্ধ

(২১ শে এপ্রিল, ১৫২৬ খ্রি.) বিশ্বাসঘাতক আফগানদের সাহায্য ছাড়াই এককভাবে স্বীয় সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে বাবর ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে দৌলতখান লােদীকে পরাজিত ও বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে লাহাের তথা সমগ্র পাঞ্জাব অধিকার করেন। এরপর "আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা" স্থাপন করে সর্বশেষ লােদী সম্রাট ইব্রাহীম লােদীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ইতিহাস প্রসিদ্ধ পানিপথের মহা প্রান্তরে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১শে এপ্রিল এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ইব্রাহীম লােদীর ১,০০,০০০ সৈন্য ও ১০০ হস্তী বাহিনী ছিল। অপরপক্ষে বাবরের সেনাবাহিনীতে ছিল ১২,০০০ পদাতিক, উল্লেখযােগ্য পরিমাণ অশ্বারোহী ও গােলন্দাজ সৈন্য। এ যুদ্ধে সর্বপ্রথম বাবর কামান ব্যবহার করেন। তাঁর কামানের গােলায় ইব্রাহীম লােদীর সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হলে বাবুর দিল্লী ও আগ্রা অধিকার করে ভারতবর্ষে মুঘল রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। এ যুদ্ধে ইব্রাহীম লােদীর প্রায় ৫০ হাজার আফগান সৈন্য হতাহত হয়। 


পানিপথের প্রথম যুদ্ধের ফলাফল 

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ যুদ্ধের ফলে লােদী বংশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইব্রাহীম লােদীর ব্যক্তিগত দুর্বলতা, অকর্মণ্যতা এবং অপরিণামদর্শিতা এবং তার সেনাবাহিনীর অপটুতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরােধিতার ফলেই সুদক্ষ সেনাপতি, দৃঢ়সংকল্প ও অদম্য স্পৃহার অধিকারী বাবরের হাতে তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ক্লাইভ যেমন ব্রিটিশ শাসনের গােড়াপত্তন করেন, ঠিক তেমনি পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করে বাবুরও ভারতবর্ষে মুঘল রাজত্বের সূচনা, করেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “পানিপথের যুদ্ধ দিল্লী সাম্রাজ্যকে বাবুরের হস্তগত করে। লােদী বংশের ক্ষমতা চূর্ণ- বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং হিন্দুস্থানের সার্বভৌমত্ব চাগতাই তুর্কিদের নিকট হস্তান্তরিত হয়।” 


পানিপথের যুদ্ধের পরবর্তী বাধা-বিপত্তি 

জনৈক ঐতিহাসিক বলেন, “বাবুরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের বিপুলতা সঠিকভাবে অনুধাবন করা যেতে পারে যদি আমরা বলি যে, পানিপথের যুদ্ধের সাথে সাথেই প্রকৃতপক্ষে তা শুরু হয়েছিল। পানিপথ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে তার পদক্ষেপ এবং এ পদক্ষেপে তার প্রথম প্রতিবন্ধকতা ছিল আফগান জাতির বিরােধিতা।” পানিপথের প্রথম যুদ্ধের পর বাবর দিল্লী ও আগ্রার অধিপতি হলেন বটে, কিন্তু সমগ্র ভারতের বাদশাহ হতে পারেন নি। ঐতিহাসিক আর. বি. উইলিয়ামের মতে, “ইব্রাহিমের সেনাবাহিনীর পরাজয়ে কেবল তাঁর কর্তব্য আরম্ভ হলাে।” যুদ্ধে ইব্রাহীম লােদী পরজিত হয়েছিলেন বটে কিন্তু জৌনপুর, দোয়াব, বাংলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলের অপরাজিত আফগান সর্দারগণ আগন্তুক  বাবরের শাসন মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা বাবুরের অগ্রাভিযান রােধকল্পে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তদুপরি মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বাধীনে রাজপুতগণ তখনকার অস্থিতিশীল অবস্থায় উপমহাদেশে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিল। পরিশেষে তার সেনাবাহিনীও এ দেশের উষ্ণ জলবায়ু সহ্য করতে না পেরে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে।

বাবুর তার জন্মগত কলাকৌশল ও মহানুভবতা দ্বারা প্রথমে দোয়াব অঞ্চলে আফগানদেরকে সাময়িকভাবে বশীভূত করেন। তৎপর পুত্র হুমায়ুন এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সেনাপতিদের সাহায্যে গাজীপুর, কনৌজ, বিয়ানা, গােয়ালিয়র, জৌনপুর প্রভৃতি অঞ্চলকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। এরপর তাঁর সেনাপতিদের জায়গীর প্রদান করে এক চিত্তগ্রাহী ও আলেকজাণ্ডারের ন্যায় উত্তেজনাময় বক্তৃতার সাহায্যে সৈন্যদলের মনােবল ফিরিয়ে আনেন। তিনি সদর্পে ঘােষণা করেন যে, “কাবুল নয়, দিল্লীই হবে মুঘলদের রাজধানী।” 


রাজপুতদের সাথে সংগ্রাম 

(খানুয়ার যুদ্ধ, ১৬ই মার্চ, ১৫২৭ খ্রি.) অসংখ্য যুদ্ধে প্রভূত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যােদ্ধা ও হিন্দু শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রানা সগ্রাম সিংহ মালব, ভিলসা, চান্দেরী, রণথম্বাের প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করে এবং আজমীর, গােয়ালিয়র, কাল্পি, সিক্রি ও রামপুরের অধিপতিবৃন্দকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে দিল্লী সাম্রাজ্য হস্তগত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পােষণ করেন। এ দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার মানসে তিনি বাবরকে দিল্লী আক্রমণের আহ্বান জ্ঞাপন করেন এবং তাকে সাহায্য করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কিন্তু তিনি তার ওয়াদার বরখেলাপ করলে বাবর তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। এ ছাড়াও আলােয়ারের হাসান খান মেওয়াটি এবং বিহারের শাসনকর্তা মাহমুদ লােদী মেবারের রানার সাথে জোট পাকালে বাবরের সাথে সংগ্রাম সিংহের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তদুপরি বাবরের সেনাবাহিনী কাল্পি, বিয়ানা, ঝােলপুর প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করলে সংগ্রাম সিংহ সেগুলাের ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব দাবি করেন। 

যাহােক, পূর্বপুরুষ তৈমুর লঙের ন্যায় এদেশ লুণ্ঠন করে বাবর যখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন না এবং বাবুর কর্তৃক বিচূর্ণিত (pulverized) মুসলিম রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর সংগ্রাম সিংহের পুনরায় হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার দুরভিসন্ধি যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলাে তখন বাবুরকে পানিপথের যুদ্ধের পর শক্তি সংগ্রহের সময় না দিয়েই বিলসার সিলহদা, ধুনগড়ের উদয়সিংহ, মারবাড়ের ভীমসিংহ, চান্দেরীর মেহেদী রাও প্রমুখ বহুসংখ্যক রাজপুত সর্দার এবং হাসান খান মেওয়াটির সমন্বয়ে তিনি একটি সামরিক আঁতাত গঠন করেন। অতঃপর রানা সগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে ১২০ জন রাজপুত সর্দার, ৮০ হাজার অশ্বারােহী (নিজামউদ্দিন আহমদের মতে, ১,২০,০০০ অশ্বারােহী), ৫ শত হস্তী বাহিনী (মতান্তরে ১ সহস্র হস্তী বাহিনী) এবং বহুসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী বাবুরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে সমরকুশলী বাবুর বিশ্ববিশ্রুত নেপােলিয়ন বােনাপার্টের ন্যায় এক অনলবর্ষী ও তেজোদীপ্ত ভাষণ দ্বারা তাঁর ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীকে অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। অতঃপর তিনি ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ ফতেহপুর সিক্রির (আগ্রার অনতিদূরে) নিকট খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতগণকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। 


খানুয়ার যুদ্ধের ফলাফল 

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে খানুয়ার যুদ্ধ একটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী ঘটনা। এ যুদ্ধে রাজপুতদের নিশ্চিতরূপে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতের মুসলমানদের সামনে বিরাজিত রাজপুত প্রাধান্যের ভীতি দূরীভূত হয়। অতঃপর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলাে। রাশব্রুক উইলিয়াম বলেন, তাঁর (বাবুরের) ভাগ্যান্বেষণের দিনের অবসান ঘটে , ভাগ্য তাঁকে ধরা দিয়েছে এবং এখন নিজেকে ভাগ্যের উপযুক্ত করে প্রমাণ করাই তার লক্ষ্য হবে ... ... যুদ্ধ ছিল এবং বহু যুদ্ধই তাঁকে করতে হবে। কিন্তু সেসব যুদ্ধ সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার জন্যই করতে হবে। কিন্তু সিংহাসনের জন্য তাকে আর কখনও যুদ্ধ করতে হবে না।” উত্ত ঐতিহাসিক আরও বলেন, “বাবুর নিশ্চিতরূপে ইব্রাহীমের সিংহাসনে নিজেকে স্থাপিত করেন। তাঁর কৃতিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নিদর্শন হলাে সুলতান ইব্রাহীমের প্রতাপশালী শত্রুর ধ্বংস সাধন। তাঁর ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু কাবুল হতে হিন্দুস্থানে স্থানান্তরিত হয়।" এ যুদ্ধের পর বাবর সুলতান উপাধি পরিত্যাগ করে বাদশাহ উপাধি ধারণ করেন। যুদ্ধের গুরুত্ব ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাসের পলাশীর পর বক্সারের যুদ্ধের অনুরূপ।


চান্দেরী দুর্গ জয় (১৫২৮ খ্রি.) 

খানুয়ার যুদ্ধের পর যুদ্ধক্ষেত্র হতে প্রত্যাগত রাজপুত বাহিনী আবার চান্দেরীর মেদেনী রাওয়ের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হলে বাবুর ঝড়ের বেগে ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি চান্দেরী দুর্গ আক্রমণ ও অবরােধ করেন। দুর্গে অবস্থানরত রাজপুত বাহিনীর প্রায় সকলেই মুঘল বাহিনীর হতে নিহত হলে চান্দেরী দুর্গও বাবুরের করতলগত হয়। অতঃপর বাবুরকে বাধা দান করার মতাে ভারতবর্যে আর কোনাে রাজপুত শক্তি অবশিষ্ট রইল না।


আফগানদের সাথে যুদ্ধ : গােগরার যুদ্ধ 

(৬ই মে, ১৫২৯ খ্রি.) ভারতের রাজপুত শক্তির বিনাশ সাধনের পর বাবুর দুর্ধর্ষ আফগান দলপতিদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে তাদের নেতা ইব্রাহীম লােদীর ভ্রাতা মাহমুদ লােদীর বিরুদ্ধে স্বীয় পুত্র আসকারীকে অগ্রভাগে পাঠিয়ে স্বয়ং যুদ্ধযাত্রা করেন। পথিমধ্যে এলাহাবাদ, চুনার, বেনারস অধিকার করে বিহারে উপস্থিত হলে বহুসংখ্যক আফগান দলপতি বাবুরের বশ্যতা স্বীকার করেন। হতাশ হয়ে মাহমুদ লােদী বাংলার সুলতান নুসরত শাহের আশ্রয় গ্রহণ করলে ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মে বাবুর পাটনার সন্নিকটে গােগরা নদীর তীরে সম্মিলিত আফগান বাহিনীকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এটাই বাবুরের ঘটনাবহুল জীবনে শেষ বৃহত্তম যুদ্ধ। 

গােগরার যুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম। এর ফলে আফগান শক্তির পুনরুত্থানের আশা নির্বাপিত হয়। এরূপে পানিপথ, ধানুয়া এবং গােগরা—এ তিনটি যুদ্ধের ফলে প্রায় সমগ্র উত্তরাঞ্চলের ওপর বাবুর স্বীয় আধিপত্য কায়েম করেন এবং তার সাম্রাজ্য অক্ষু নদী হতে গােগরা নদী এবং হিমালয় হতে গােয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। প্রথম জীবনে ভাগ্যবিড়ম্বিত বাবুর স্বীয় যােগ্যতা, সৌভাগ্য ও অনুকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। 


সম্রাট বাবরের সাফল্যের কারণ 

প্রথমত, ইব্রাহীম লােদীর ভ্রান্ত নীতি, আফগান অভিজাতবর্গের মধ্যে ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও সন্দেহ এবং জনগণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় তার পরাজয় ঘটে এবং বাবরের বিজয় নিশ্চিত করে। 
দ্বিতীয়ত, ইব্রাহীম লােদীর অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও নৈতিক সাহসহীন সেনাবাহিনীও তার পতনের জন্য দায়ী ছিল। এটিও বাবরের সাফল্যের অনুকূলে ছিল। 
তৃতীয়ত, ইব্রাহীম লােদী ও আফগানদের সাথে মেবারের রানা সংঘের কখনও একাত্মতা ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি বলে তারা সকলেই পর্যায়ক্রমে বাবরের হাতে পরাজয় বরণ করেন। 
চতুর্থত, বাবরের নির্ভীক ও দক্ষ সেনাপতিত্ব, মুঘল সেনাবাহিনীর ধর্মীয় ও জাতীয়তাবােধ, উন্নত যুদ্ধকৌশল ও কামান প্রভৃতির ব্যবহার এবং সাম্রাজ্য স্থাপনের অটুট সংকল্প ও অদম্য মনােবল ইত্যাদি বাবুরের ভারতীয় নরপতিদের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধেই বিজয়ের পথ সুগম করে দিয়েছিল। 

পরিশেষে বাবুরের ভারত আক্রমণের প্রাক্কালে এ দেশের রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার সুযােগ বাবুর পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। 


সম্রাট বাবরের মৃত্যু 

বাবুর তার বিজয়ের ফল দীর্ঘদিন ভােগ করতে পারেননি। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি পরলােক গমন করেন। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে জ্যেষ্ঠ পুত্র হুমায়ুন গুরুতররূপে অসুস্থ হয়ে পড়লে স্নেহাতুর পিতা বাবুর অত্যন্ত বিচলিত বােধ করেন। অতঃপর তিনি তিনবার পুত্রের রােগশয্যার চারদিক প্রদক্ষিণ করে আল্লাহর দরবারে নিজ জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চান। এর ফলে অল্পকালের মধ্যেই হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং বাবর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে ডিসেম্বর ৪৮ বছর বয়সে এ নশ্বর জগৎ হতে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে কাবুলে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান সেখানে একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন।
 

সম্রাট বাবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব 

ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে বাবর একটি আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যুবরাজ, যােদ্ধা এবং বিদ্বান হিসেবে মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের সাথে তিনি যােগ্য আসন লাভের অধিকারী। প্রাথমিক জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত এবং দুঃসাহসিকতা তার শারীরিক কাঠামােকে শক্তিশালী করে এবং এর ফলে তিনি ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সাহস, আত্মনির্ভরশীলতা প্রভৃতি গুণাবলির অধিকারী হন। দুঃখ-দুর্দশা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পাদপীঠ এবং বাবর জীবনের সুখ ও দুঃখের দ্বারা বিশেষভাবে লাভবান হয়ে ওঠেন।” তার চরিত্রে অদম্য অধ্যবসায়, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, অনন্যসাধারণ দুঃসাহসিকতা, অটুট মনােবল, অতুলনীয় রণদক্ষতা, দূরদর্শী রাজনৈতিক এবং চমৎকার শিল্পজনােচিত গুণাবলির এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তার ধমনীতে বিশ্বাস সৃষ্টিকারী তৈমুর লঙ ও চেঙ্গিসের শােণিত ধারা প্রবাহিত হলেও অনর্থক ও অপ্রয়ােজনীয় ধ্বংস, লুণ্ঠন কিংবা নৃশংসতার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “তিনি শত্রুদের প্রতি যে মহানুভবতা প্রদর্শন করতেন তার দৃষ্টান্ত মধ্য এশিয়ায় তাঁর সমসাময়িক শাসকদের মধ্যে ছিল বিরল।” ভি. এ. স্মিথ বলেন, “বাবর তার সমসাময়িক এশীয় যুবরাজদের মধ্যে খুবই উন্নত এবং ভারতের নৃপতিগণের মধ্যে সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হবার যােগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন।” 

সম্রাট বাবরের ধার্মিকতা: বাবর একাধারে ছিলেন স্নেহময় পিতা, অকৃত্রিম ও বিশ্বস্ত বন্ধু, মহান ও দয়ালু শাসক এবং খাঁটি ঈমানদার মুসলমান; উদার, বিনয়ী, নম্র, বিশ্বস্ত ও মনােমুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বাবর সম্পর্কে লেনপুল বলেন, “তিনি যাযাবর তাতারদের উচ্ছৃঙ্খল শৌর্য-বীর্য এবং তুর্কিদের কর্মোদ্যম ও দক্ষতার সাথে পারসিকদের মার্জিত সংস্কৃতি ও শিষ্ট আচরণের সমন্বয় সাধন করেন।" ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং এমন কি সামাজিক জীবনেও তিনি ছিলেন সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। তিনি তার চাগতাই গােষ্ঠীদের, আত্মীয়-স্বজনদের, বন্ধু-বান্ধবদের, আমীর-ওমরাহদের কিংবা ভৃত্যদের প্রতি কখনও দুর্ব্যবহার করতেন না। বাবুর মধ্যযুগীয় শাসকদের দোষ-ত্রুটি হতে বহুলাংশে মুক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি মদ্যপান করতেন বটে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে খানুয়ার যুদ্ধের পর আর কোনােদিনই তিনি মদ্য স্পর্শ করেননি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি সুন্নী মুসলমান এবং আল্লাহর প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত আস্থাশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। এতদসত্ত্বেও অমুসলমান প্রজাবর্গের প্রতি তিনি উদারতা, সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতেন। ঈশ্বরীপ্রসাদ বলেন, “কিন্তু তার রাজত্বকালে হিন্দুদেরকে নিয়মিতভাবে নিগ্রহ ভােগ করতে হয় নি এবং শুধুমাত্র ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি কখনও কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করেননি। সম্রাট নেপােলিয়নের ন্যায় বাবরও মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কিংবা রাজকার্যে হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। রাশব্রুক উইলিয়ামস্ বলেন, “বাবর আটটি মৌলিক গুণের অধিকারী ছিলেন– সুউচ্চ বিচারবুদ্ধি, মহৎ আকাঙ্ক্ষা, বিজয়লাভের কলাকৌশল, প্রশাসনিক দক্ষতা, জনগণের সমৃদ্ধি সাধনের প্রবণতা, আল্লাহর বান্দাদের মহানুভবতার সাথে শাসন করার প্রতিভা, সেনাবাহিনীর মন জয়ের ক্ষমতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা।” 

বিজেতা ও সেনাপতি হিসেবে বাবর: বাবর ছিলেন মুসলিম বিশ্বের রবার্ট ব্রুস। বারবার পিতৃপ্রদত্ত রাজ্য ফরগনা কিংবা সমরকন্দ হারিয়েও তিনি কখনও নিরুৎসাহ হননি—বরং অদম্য সাহসকে সম্বল করে ভাগ্য পরীক্ষায় নিজেকে নিয়ােজিত রাখেন। ফলে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-ক্লেশ, দুঃখ ও যাতনা ভােগের পর অবশেষে জীবনে সাফল্য অর্জন করেন। দাবা খেলার রাজার ন্যায় তিনি একস্থান হতে অন্যস্থানে পরিভ্রমণ করেছিলেন—কিন্তু কখনও ধৈর্যচ্যুত হন নি। সহায়সম্বলহীন এবং রাজ্যহারা হয়েও ভারতীয় উপমহাদেশে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেছেন। লেনপুল বলেন, “ভারত বিজয় দ্বারা তিনি যে রাজকীয় শাসকগােষ্ঠীর জন্য পথ উন্মুক্ত করেছেন তা-ই ইতিহাসে তাকে স্থায়ী আসন দান করেছে।” রাশব্রুক উইলিয়ামস্ বাবুরকে “ষােড়শ শতাব্দীর একজন সাম্রাজ্য স্থাপয়িতা” হিসেবে অভিহিত করেছেন। নির্ভীক সৈনিক, সুদক্ষ অস্ত্র পরিচালক, রণনিপুণ সেনাপতি এবং প্রশংসনীয় ঘােড়সওয়ার বাবর দিগ্বিজয়ী আলেকজাণ্ডারের ন্যায় দেশ জয়ের নেশায় হিন্দুস্থান অভিযানে আগমন করে কখনও বিপর্যস্ত হন নি। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লােদীকে, ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহকে, ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে চান্দেরী অভিযানে মেদেনী রাওকে এবং ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে গােগরার যুদ্ধে আফগান শক্তিকে চূর্ণ করে তিনি যে রণচাতুর্য, সামরিক দক্ষতা, অসাধারণ প্রতিভা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে তাকে এক সুউচ্চ আসন ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। লেনপুল আরও বলেন, "একজন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক এবং কোনাে সাম্রাজ্য সৌধের স্থপতি না হয়েও তিনি গৌরবময় সাম্রাজ্য সৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে যান যাকে তাঁরই পৌত্র আকবর এক পরিপূর্ণ রূপ দান করেন।” বাবর শুধু ভারতবর্ষেরই বাদশাহ ছিলেন না, বরং লেনপুলের ভাষায়, ["He is the link between Central Asia and India, between predatory hordes and Imperial government of Asia, Chingez and Timur."] "মধ্য এশিয়া এবং ভারতবর্ষের মধ্যে, লুণ্ঠনকারী তাতার বাহিনী ও এশিয়ার রাজকীয় সরকারের মধ্যে এবং চেঙ্গিস খান ও তইমুরের মধ্যে যােগসূত্র রচনাকারী ছিলেন তিনি।" ত্রিপাঠী বলেন, "আকবরকে তার শ্রেষ্ঠত্ব হতে বঞ্চিত না করেও বলা যেতে পারে যে, তাঁর স্বনামধন্য পিতামহই তাঁর নীতি -পদ্ধতির বীজ বপন করে যান।” কর্ম ছিল বাবুরের জীবনের ধর্ম। দেহ-মনে তার কোনাে অবসাদ ছিল না। বস্তুত তিনি ছিলেন নিরলস কর্মী এবং এটাই ছিল তার সফলতার মূল চাবিকাঠি। 

শাসক হিসেবে সম্রাট বাবর: সংগ্রামী জীবনের স্বল্প পরিসরে বাবর নব বিজিত সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযােগ ও সময় পাননি বলে তিনি বিজিত অঞ্চলে প্রচলিত শাসনব্যবস্থাকেই মােটামুটি বলবৎ রাখেন। বাবুর ইতােপূর্বের তুর্কি-আফগান আমলের শাসন ব্যবস্থাকেই যৎসামান্য পরিবর্তনসহ কার্যকরী করেন। খলিফার শিথিল প্রকৃতির ক্ষমতাকে অস্বীকার করে সার্বভৌম ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বাবুর নিজেকে ‘বাদশাহ' বলে ঘােষণা করেন। সামন্ত ও জায়গীরদারি প্রথা চালু রাখলেও তিনি সামন্ত ও জায়গীরদারগণকে ভৃত্যের ন্যায় অনুগত দাসে পরিণত করেন। প্রধানমন্ত্রী নিজামউদ্দিন খলিফা বিভাগীয় প্রধানদের সাথে বাদশাহের যােগাযােগ বহাল রাখতেন। প্রাদেশিক শাসনকার্য পরিচালনা করতেন ওয়ালী (প্রাদেশিক গভর্নর) , দিওয়ান (রাজস্ব কর্মকর্তা), শিখদার (সমর কর্মকর্তা) ও কোতয়াল (নগর কর্মকর্তা)। সমগ্র সাম্রাজ্যে ১৫ মাইল অন্তর অন্তর তিনি ডাকচৌকির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দিল্লী ও আগ্রায় প্রাপ্ত ধন-সম্পদ অনুচরবর্গের মধ্যে মুক্ত হস্তে বিতরণ করে এবং স্ট্যাম্পকর বাতিল করে তিনি রাজস্ব ব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি করেছিলেন। এ জন্য রাশব্রুক উইলিয়ামস্ বলেন, “বাবুর তার পুত্রের জন্য এমন এক রাজতন্ত্র বা সাম্রাজ্য রেখে যান যা কেবল যুদ্ধাবস্থা দ্বারাই সমন্বিত রাখা ছিল সম্ভব, যা শান্তিকালীন অবস্থায় ছিল দুর্বল, কাঠামােহীন এবং মেরুদণ্ডবিহীন।” যা হােক জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে থেকে বাবর তুর্কি, আফগান ও হিন্দুদেরকে প্রশাসনিক কার্যে নিযুক্ত করতেন। তিনি দিলওয়ার খান লােদীকে ‘খান-ই-খানান' উপাধি প্রদান করে এবং চান্দেরীর মেদিনী রাওয়ের দুই কন্যাকে হুমায়ুন এবং কামরানের সাথে বিয়ে দিয়ে উদারতার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর স্থাপন করেন। প্রজারঞ্জক বাবর দিল্লী ও আগ্রায় ২০টি উদ্যান, বহু পাকা নর্দমা, সেতু, অট্টালিকা প্রভৃতি নির্মাণ করেন।

বাবরের সাহিত্য ও শিল্পানুরাগ: লেনপুল বলেন, “মধ্য এশিয়া ও ভারতবর্ষের ল্যাটিন এবং সংস্কৃতির ভাষা ফারসিতে বাবুর কীর্তিমান কবি ছিলেন এবং তার মাতৃভাষা তুর্কিতে গদ্য রচনা করেন এবং কবিতায় তিনি বিশুদ্ধ ও স্বাভাবিক রীতি প্রচলন করেন।" তার রচিত 'দিওয়ান' (তুর্কি কবিতার সকলন) তার সাহিত্যিক প্রতিভারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। 'মুবইয়ান’ নামক ফার্সি ভাষায় এক প্রকার নতুন ছন্দ আবিষ্কার করে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রচিত আত্মজীবনী “তুযুক-ই-বাবর’ মুঘল ইতিহাসের একটি অমূল্য সম্পদ। “বাবর যদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নাও হতেন তবুও তিনি অমর হয়ে থাকতেন তার কাব্য প্রতিভার গুণে।" এক কথায়, বাবর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থভাবেই বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে প্রতিভা ও গুণরাজির দিক দিয়ে এশিয়ার ইতিহাসে খুব কম শাসকই বাবর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন।


তুযুক-ইবাবর (বাবরের আত্মজীবনী)

তুর্কি সাহিত্যের ইতিহাসে ‘তুযুক-ই-বাবর' একটি শ্রেষ্ঠ অবদান। সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত এই আত্মজীবনীতে বাবর তার নানা স্মৃতি বিজড়িত জীবন কথা, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, দেযগুণ, জ্ঞান ও মূর্খতা অকপটে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তার অকৃত্রিম বর্ণনা, ভাষায় কারুকার্য ও প্রাঞ্জলতা বিশ্ববাসীর প্রশংসা অর্জন করেছে। ঐতিহাসিকগণের মতে বিশ্বের পাঁচটি সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনচরিতের মধ্যে এটা অন্যতম বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। স্যার ই. ডেনিসন রস বলেন, “বাবরের আত্মচরিত সর্বযুগের সাহিত্যের মনােমুগ্ধকর এবং রােমাঞ্চকর সৃষ্টিকর্মগুলাের অন্যতম বলে গণ্য হবে।” বাবর তার কর্মব্যস্ত জীবনে অবসর মুহূর্তগুলােকে তুর্কি ভাষায় আত্মচরিত রচনার কাজে ব্যয় করেছেন। সংস্কৃতিমনা, বিদ্যোৎসাহী, সুসাহিত্যিক বাবর সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত কবি, প্রকৃতি পূজারী, সঙ্গীতজ্ঞ ও হস্তলিপিকার ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক ও আত্মীয় মীর্জা হায়দার ডুগলাট বলেন, “তুর্কি কবিতা রচনায় তিনি (শ্রেষ্ঠত্বে) শুধু আমীর আলী শেরের দ্বিতীয় ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জল তুর্কি ভাষায় একটি দিওয়ান রচনা করেন। 'মুবাইয়ান' নামক একটি নতুন ছন্দ তিনি আবিষ্কার করেন এবং আইন-শাস্ত্র বিষয়ে সর্বজনগ্রাহ্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। তুর্কি ছন্দ প্রকরণের ওপরও তিনি একটি প্রবন্ধ রচনা করেন যা অন্য যে কোনাে রচনার চেয়ে সমৃদ্ধ। তারপর আছে তার ওয়াকাই বা তুর্কি ভাষায় রচিত আত্মজীবনী যা সহজ, সরল অথচ খাটি পদ্ধতিতে লিখিত।” সাহিত্য-সম্পদ এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে তার আত্মচরিতের গুরুত্ব সত্যিই অপরিসীম। 

প্রথমত, ‘তুযুক-ই-বাবর' বাবরের স্বীয় জীবন এবং রাজত্বের ইতিহাস সংগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক উৎস। এর মাধ্যমে ঐতিহাসিকগণ মানুষ বাবর এবং সম্রাট বাবর সম্পর্কে সম্যক তথ্য আহরণ করতে পারেন। 

দ্বিতীয়ত, এ গ্রন্থে সে যুগের ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। এতে বাবুর লিপিবদ্ধ করেছেন—“ভারতের অধিবাসিগণ সুদর্শন নয়। একত্রে মিলে মিশে বন্ধুভাবাপন্ন সমাজে বসবাসের যে একটি অনাবিল আনন্দ রয়েছে, সে সম্বন্ধে তাদের কোনাে ধারণাই নেই। তাদের প্রতিভা নেই, কারিগরি জ্ঞান ও আবিষ্কারের দিকেও কোনাে আগ্রহ নেই।” ভারতবর্ষ সম্পর্কে বাবরের একমাত্র প্রশংসা হচ্ছে যে, “স্বর্ণ ও রৌপ্যপূর্ণ এটা একটি বিরাট দেশ।” এ ধারণার যথার্থতা সম্পর্কে অনেক আধুনিক ঐতিহাসিক ভিন্নমত পােষণ করেন। 

তৃতীয়ত, বাবরের রচিত আত্মচরিত এমন একটি উৎকৃষ্ট ও সুলিখিত সাহিত্য যে তা পাঠ করলে পাঠকের সম্মুখে আসল ঘটনা ভেসে ওঠে। 

আব্দুর রহিম খান-ই-খানান এবং পায়েন্দখান ‘তুযুক-ই-বাবুর’ গ্ৰন্ধটিকে দুই বার তুর্কি হতে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে লিডেন এবং এরসকাইন কর্তৃক এটা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এ. এস. বিভারিজ মূল গ্রন্থটিকে তুর্কি হতে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করায় তার সংস্করণটিই অধিকতর নির্ভরযােগ্য ও বিশ্বস্ত বলে গণ্য হয়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে “তুযুক’ ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। 

ইলিয়ট ও ডাওসন ‘তুযুক-ই-বাবরকে’ “বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও নির্ভরযােগ্য আত্মচরিত” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাশব্রুক উইলিয়ামস্ বলেন, “বাবর ভারত বিজয়ের জন্য ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন, আর আত্মচরিত ও সাহিত্য জগতে তার আসন স্বীকৃত হয়েছে তার চমৎকার আত্মচরিতের জন্য।” ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থভাবেই বলেছেন, “পূর্বদেশীয় কোনাে নৃপতিই বাবরের ন্যায় এরূপ সুষ্পষ্ট, মনােমুগ্ধকর এবং সত্যনিষ্ঠ আত্মজীবনী রচনা করেন নি।”

তথ্যসূত্র: 
বই: ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি 
লেখক: হাসান আলী চৌধুরী

নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত লিখুন :