জালালউদ্দিন খলজী এর জীবনী - Biography of Jalaluddin Khilji

জালালউদ্দিন খলজী এর জীবনী - Biography of Jalaluddin Khilji - Bongo Tweet

জালালউদ্দিন খলজীর সিংহাসনারােহণ 

দাস বংশের দশম সুলতান পঙ্গু কায়কোবাদকে নদীগর্ভে বিসর্জন দিয়ে এবং ঐ বংশের সর্বশেষ শিশু সুলতান কায়মুরসকে কারাগারে নিক্ষেপ করে জালালউদ্দিন ফিরােজ খলজী ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে সত্তর বছর বয়সে সিংহাসনে আরােহণ করেন। বস্তুত রাজনৈতিক গােলযােগ ও অস্থিরতার মধ্যে খলজী আমীরগণ একটি বিপ্লব সংঘটিত করেন। দিল্লীর আমীর ও নাগরিকগণ তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন নি বলে তিনি দিল্লীর নিকটবর্তী কিলােঘেরিতে তার অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং তথায় এক বছরকাল অবস্থান করেন। 

হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করলেও তিনি তার উদারতা, বদান্যতা ও শান্ত প্রকৃতির জন্য অবশেষে জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে দিল্লীর নাগরিকগণের আমন্ত্রণে তিনি দিল্লীতে আগমন করেন। 


জালালউদ্দিন খলজীর বিদ্রোহ দমন 

সুলতান জালালউদ্দিনের রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে বলবনের ভ্রাতুষ্পুত্র এবং কারা প্রদেশের শাসনকর্তা মালিক সাজজু (কিশলু খান) বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। তিনি সুলতান উপাধি ধারণ করে অযােধ্যার শাসনকর্তা হাতিম খানের সাথে সম্মিলিত হয়ে দিল্লী অভিমুখে রওয়ানা হন। কিন্তু বদাউনের সন্নিকটে সংঘটিত যুদ্ধে সুলতানের জ্যেষ্ঠপুত্র আরকলি খানের হস্তে বিদ্রোহিগণ পরাজিত হয়। সাজজুকে বন্দী অবস্থায় সুলতানের সম্মুখে হাজির করা হলে সুলতান তাকে মুক্তিদান করেন। কারার শাসনভার সুলতান তার ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা আলাউদ্দিনের উপর অর্পণ করেন। সুলতানের এরূপ করুণা প্রদর্শনে খলজী আমীরগণ সুলতানের উপর বিরক্ত হন। 

খলজী আমীর-ওমরাহগণ সুলতানের দয়া ও ক্ষমাকে তার দুর্বলতা মনে করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েন। তারা তাজউদ্দিন কুচী অথবা আহমদ চ্যাপকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার চক্রান্তে তৎপর হয়ে ওঠেন। এটা অবগত হয়ে সুলতান বিদ্রোহী আমীরদের বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শুধুমাত্র তাদেরকে সাবধান করেই ক্ষান্ত হন। 

একদা একদল চোরকে গ্রেপ্তার করে তার সম্মুখে আনয়ন করলে সুলতান তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান না করে সদুপদেশ দান করে ছেড়ে দেন। দিল্লীর জনজীবন অতিষ্ঠকারী একদল ঠগদস্যুকে বন্দী করা হলে সুলতান তাদেরকে অনুরূপভাবে বঙ্গদেশের সীমানায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতে আদেশ করেন। 

তবে প্রয়ােজনবােধে সুলতান জালালউদ্দিন যে কঠোরতম শাস্তি প্রদান করতে পারেন তার প্রমাণ সিদি মৌলার নৃশংস হত্যায় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন পাক-পত্তনের শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই-শকর-এর শিষ্য এবং যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দরবেশ। তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং স্বীয় অনুচরদের নিকট তিনি নিজেকে খলিফা হিসেবে পরিচয় প্রদান করেন। সুলতানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন বলে সন্দেহ করে সিদি মৌলাকে সুলতানের আদেশে হস্তীর পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করা হয়। 


মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিরােধ 

মােঙ্গল নেতা হালাকু খানের পৌত্র আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে লক্ষাধিক মােঙ্গলবাহিনী সিন্ধুনদ অতিক্রম করে সুনাম পর্যন্ত অগ্রসর হলে জালালউদ্দিন তাদেরকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করেন (১২৯২ খ্রি.)। যুদ্ধশেষে অধিকাংশ মােঙ্গল ভারত ত্যাগ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু উলুঘ খান নামক চেঙ্গিস খানের জনৈক বংশধর তার অনুচরবর্গসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দিল্লীর উপকণ্ঠে বসবাস করতে থাকে। ভারতের ইতিহাসে তারা ‘নব-মুসলমান' নামে পরিচিতি লাভ করে। উলুঘ খানের সাথে সুলতান স্বীয় কন্যার বিবাহ প্রদান করে মােঙ্গলদেরকে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করেন। যা হােক, পরবর্তীকালে ‘নব-মুসলমানগণ’ দিল্লীর সুলতানদের জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী উৎপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


জালালউদ্দিন খলজীর অভিযানসমূহ 

১২৯০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান রণথম্ভোর দুর্গটি অধিকারের জন্য দুবার ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেন। সংঘর্ষে বহু মুসলিম সৈনিকের প্রাণহানি হবার আশঙ্কায় সুলতান উক্ত অভিযানটি পরিত্যাগ করেন। 

তবে তার শাসনামলে তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা এবং কারা ও অযোধ্যার শাসনকর্তা আলাউদ্দিন মালব ও দেবগিরি রাজ্যের বিরুদ্ধে দুটি সাফল্যজনক অভিযান পরিচালনা করেন। উচ্চাভিলাষী আলাউদ্দিন খলজী সুলতানের অজ্ঞাতে ১৮,০০০ অশ্বারােহী সৈন্যের এক বাহিনীসহ সমৃদ্ধিশালী দেবগিরি রাজ্য আক্রমণ করেন। প্রথমে তিনি রাজা রামচন্দ্র দেবকে এবং পরে তাঁর পুত্র শঙ্কর দেবকে পরাজিত করে ৬০০ মণ স্বর্ণ, ১০০০ মণ রৌপ্য, ৭ মণ মুক্তা, ২ মণ মূল্যবান প্রস্তর, ৪০টি হাতী, কয়েক হাজার ঘােড়া ইত্যাদি দ্রব্যসহ কারায় ফিরে যান। 


জালালউদ্দিনের প্রাণনাশ (১২৯৬ খ্রি.) 

বৃদ্ধ সুলতান ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা আলাউদ্দিনের দেবগিরি অভিযানের সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে তাকে অভিনন্দন জানাবার উদ্দেশ্যে সভাসদ ও পরামর্শদাতাদের সতর্কবাণীকে উপেক্ষা করে স্বয়ং কারায় হাজির হন। সুলতান ভ্রাতুস্পুত্রকে আলিঙ্গন করতে অগ্রসর হলে পূর্ব-পরিকল্পিত ব্যবস্বানুযায়ী মুহম্মাদ সেলিম এবং তার সহযােগী তাদের তরবারির আঘাতে জালালউদ্দিনকে হত্যা করে। অতঃপর আলাউদ্দিন নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন।


জালালউদ্দিনের চরিত্র ও কৃতিত্ব 

তথাকথিত দাস বংশের ধ্বংসাবশেষের উপর জালালউদ্দিন খলজী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি যেমন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, ঠিক তেমনি নিয়তির অমােঘ বিধানে ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা আলাউদ্দিন খলজীর চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়ে জালালউদ্দিন খলজীকে জীবন ও সিংহাসন হারাতে হয়। 

সুলতানের শাসননৈপুণ্য ও সমরকুশলতার অভাব পরিলক্ষিত না হলেও বিদ্রোহী আমীর-ওমরাহ এবং শত্রুদের প্রতি তার নমনীয় মনােভাবের ফলে রাজদরবারের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এবং আমীর ও ওমরাহগণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠে। সিদি মওলার বিরুদ্ধে তিনি যেরূপ কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বর্গী দস্যুদের এবং বিদ্রোহী সাজজুর বিরুদ্ধেও সেরূপ কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তিনি মারাত্মক ভুল করেছিলেন। মুসলিম সৈন্যদের প্রাণহানির কথা বিবেচনা করে রণথম্ভাের অভিযান পরিহার করা তার দুর্বলতার স্বাক্ষরই বহন করে। তবুও সুলতান জালালউদ্দিন ফিরােজকে ‘উদার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আদর্শ স্থাপনকারী’ দিল্লীর প্রথম সুলতান হিসেবে অভিহিত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। রাজা হিসেবে ব্যর্থ হলেও ফিরােজ ছিলেন একজন খাটি ভদ্রলােক এবং তার সময়ের অন্যতম বিখ্যাত ধার্মিক মুসলমান।

তথ্যসূত্র : 
বই : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : হাসান আলী চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন