গিয়াসউদ্দিন বলবন এর জীবনী - Biography of Ghiyasuddin Balban

গিয়াসউদ্দিন বলবন এর জীবনী - Biography of Ghiyasuddin Balban - Bongo Tweet

বলবনের প্রকৃত নাম ছিল বাহাউদ্দিন। বলবন ছিল তার উপাধি। উলুঘ খান তাঁর দ্বিতীয় উপাধি এবং গিয়াসউদ্দিন ছিল তাঁর রাজ-উপাধি। তিনি জাতিতে তুর্কি এবং ইলবারি গােত্রভুক্ত। যৌবনে বলবন মােঙ্গলদের হাতে বন্দী হয়ে বাগদাদের খাজা জামালউদ্দিন বসরীর নিকট ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রীত হন। ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে জামালউদ্দিন অন্যান্য ক্রীতদাসের সাথে তাকে দিল্লীতে এনে ইলতুৎমিশের নিকট বিক্রয় করেন। 

সুলতান ইলতুৎমিশ বলবনকে তার ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বিখ্যাত ‘চল্লিশ ক্রীতদাসের' অন্তর্ভুক্ত করে ‘খাসবরদার’ (ব্যক্তিগত ভৃত্য) পদে নিয়ােগ করেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় বিমুগ্ধ হয়ে সুলতানা রাজিয়া তাকে “আমীর-ই-শিকার” পদে নিযুক্ত করেন। বাহরাম বলবনকে রেওরীর এবং পরবর্তীকালে হান্সীসহ অঞ্চলের ভূস্বামী নিযুক্ত করেন। এর কিছুকাল পরে তিনি “আমীর-ই-হাজীব” (রাজ গৃহাধ্যক্ষ) পদে নিয়ােগ লাভ করেন। পাঞ্জাবে মঙ্গু খানের নেতৃত্বে মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি অসামান্য সাহস ও সমর-নৈপুণ্যের জন্য ‘উলুঘ খান’ উপাধিতে বিভূষিত হন। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসিরউদ্দিন বলবনকে “নায়েব-ই -মামলিকাত” পদে নিযুক্ত করেন। অতঃপর সুলতান নাসিরউদ্দিনের সাথে স্বীয় কন্যার বিবাহ প্রদান করে তিনি সাম্রাজ্যের সকল দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তা হয়ে বসেন। কিন্তু ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে বলবনের বিরুদ্ধবাদী তুর্কি আমীরগণ ইমাম উদ্দিন রায়হান নামক জনৈক ধর্মান্তরিত ভারতীয় মুসলিম আমীরের নেতৃত্বে বলবনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হন। তবে বলবন ১২৫৪ খ্রিস্টাব্দেই তার সহকর্মীদের সহায়তায় পূর্বপদে পুনর্বহাল হয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হন।

১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে বলবন মুলতান এবং ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে অযােধ্যার বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি মােঙ্গালদের আক্রমণের হাত হতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা বিধান করতেও সক্ষম হন। বাংলা ও বিহারের অশান্ত পরিস্থিতিকেও তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। এরপর তিনি কালিঞ্জর ও গােয়ালিয়রের হিন্দু নরপতিগণকে এবং মেওয়াটের উপজাতিদেরকে দমন করে দোয়াবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে নাসিরউদ্দিনের ২০ বছর রাজত্বকালে বলবন দাসবংশকে নানাবিধ বিপদের হাত হতে রক্ষা করেন। এজন্য বলা হয় যে, নাসিরউদ্দিন ২০ বছর রাজত্ব করেন, কিন্তু এসময় শাসন করেন বলবন। বলবনের তেজস্বিতা এবং কর্মোদ্যম ব্যতীত দিল্লী সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের এবং বৈদেশিক আক্রমণের চরম আঘাত হয়ত সহ্য করতে পারত না।


বলবনের সিংহাসনারােহণ

অপুত্রক নাসিরউদ্দিন মাহমুদ মৃত্যুকালে তদীয় শ্বশুর এবং প্রধানমন্ত্রী বলবনকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন। ৬০ বছর বয়সে বলবন গিয়াসউদ্দিন উপাধি ধারণ করে দিল্লীর মসনদে আরােহণ করেন। 


সাম্রাজ্যের সমস্যাবলি 

বলবন সিংহাসনে আরােহণ করে প্রায় শূন্য রাজকোষ, আমীর-ওমরাহ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান ঔদ্ধত্য, দ্বন্দ্ব-কলহ ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ, দিল্লীর সন্নিকটস্থ মেওয়াটী দস্যুদের ক্রমবর্ধমান উপদ্রব, উপর্যুপরি মােঙ্গালদের আক্রমণে সাম্রাজ্যের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। ইলতুৎমিশের উত্তরাধিকারিগণের দুর্বলতার জন্য কেন্দ্রীয় রাজশক্তির প্রতি জনসাধারণের অশ্রদ্ধা সর্বত্র বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল। এরূপ পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য বলবন ছিলেন যােগ্যতম ব্যক্তি। 


কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্গঠন 

সুলতান হিসেবে বলবনের জীবন ছিল অভ্যন্তরীণ গােলযােগ এবং বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামের জীবন। রাজকীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে সুলতানের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য, রাজনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণের উদ্দেশ্যে, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন এবং মােগল আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়ােজনে বলবন ‘blood and iron policy' (রক্তপাত ও কঠোর নীতি) অবলম্বন করেন। বিরাজমান সমস্যা মােকাবিলার জন্য সেটিই উপযুক্ত নীতি। 

ক. রাজতন্ত্র সম্পর্কে বলবনের ধারণা এবং সালতানাতের মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা : বলবন রাজাকে আল্লাহর প্রতিনিধি মনে করতেন। বলবনের মতে, ‘রাজার হৃদয় হচ্ছে আল্লাহর অনুগ্রহের একটি বিশেষ ভাণ্ডার এবং এক্ষেত্রে মনুষ্য সমাজে তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। তিনি ‘জিদুল্লাহ' (Zillullah) বা আল্লাহর ছায়া অথবা প্রতিনিধি উপাধি ধারণ করেন। রাজতন্ত্রকে শ্রদ্ধান্বিত করার উদ্দেশ্যে তিনি মুদ্রায় মৃত আব্বাসীয় খলিফার নাম অঙ্কন করেন। রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে তিনি ৪টি কর্তব্য সম্পাদন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সেগুলাে হচ্ছে- 
  • ধর্মকে রক্ষা করা এবং শরীয়তের শাসন কায়েম করা।
  • পাপাচার ও দুর্নীতির বিলােপ সাধন করা।
  • সৎ, ধর্মপরায়ণ ও সদ্বংশীয় লােকদের রাজকার্যে নিয়ােগ করা।
  • সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। 
বলবন রাজার দৈহিক পবিত্রতায়ও ছিলেন বিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন স্বেচ্ছাচারী রাজক্ষমতাই একমাত্র জনগণের আনুগত্য লাভ ও রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করতে সক্ষম। এরূপ ধারণার বশবর্তী হয়ে সুলতানের প্রতি রাজ্যের জনগণের শ্রদ্ধা ও ভীতি জাগাবার জন্য তিনি প্রাচীন পারস্যরাজদের ন্যায় কঠোর রীতি এবং জাঁকজমকপূর্ণ রাজদরবার প্রবর্তন করেন। এ প্রসঙ্গে বারানী বলেন, “বলবনের প্রচেষ্টায় দিল্লীর রাজদরবার গজনীর রাজদরবারের ন্যায় জমকালাে ও আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং উক্ত জাঁকালাে দরবার পরিদর্শন করতে জনগণ সুদূর ৪০০ মাইল পথ অতিক্রম করে দিল্লীতে আগমন করত।” 
  • প্রথমত, পারসিক আদব-কায়দায় সিজদা ও পাইবস্ রীতির তিনি প্রবর্তন করেন। 
  • দ্বিতীয়ত, রাজসভায় তিনি নৃত্যগীত, মদ্যপান প্রভৃতির বিলুপ্তি সাধন করেন। 
  • তৃতীয়ত, সুলতান রাজকর্মচারি ও আমীরগণের জন্য এক বিশেষ ধরনের পােশাকের ব্যবস্থা করেন। 
  • চতুর্থত, নীচ বংশােদ্ভূত লােকদের নিকট হতে উপহার গ্রহণ কিংবা তাদের সাথে বাক্যালাপ করাও সুলতান বন্ধ করেন। 
  • পঞ্চমত, রাজদরবারে গাম্ভীর্য রক্ষার জন্য সুলতান লঘু-চপলতা, হাসিঠাট্টা ইত্যাদি পরিহার করেন। সুলতান স্বয়ং শাহী পােশাকে সুসজ্জিত থাকতেন। কথিত আছে যে, ব্যক্তিগত ভৃত্যদের সম্মুখেও কখনও তিনি সাধারণ পােশাকে বের হতেন না। এরূপ কঠোর নীতির প্রবর্তন করে সুলতান রাজতন্ত্রের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং সালতানাতের কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করেন। 
খ. সামরিক সংস্কার : জার্মানির বিসমার্কের ন্যায় সুলতান বলবনও সামরিক শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে মনস্থ করেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের শাসনামল হতে সেনাবাহিনীকে নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেয়ার প্রথা বিদ্যমান ছিল। এ ব্যবস্থার ফলে সৈন্যদের বংশধরগণ সামরিক কর্তব্য পালন না করেও জায়গীর ভােগ করত। এ অব্যবস্থা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে বলবন জায়গীরদারী প্রথার বিলুপ্তি সাধন করেন। তিনি শুধুমাত্র সামরিক কর্তব্য পালনে উপযােগী লােকদেরকে নিয়মিত বাহিনীতে ভর্তি করেন। তিনি তাদের প্রচুর সুযােগ-সুবিধা প্রদানসহ বর্ধিত বেতন প্রদানেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অতঃপর বয়ােবৃদ্ধ সৈনিকগণ অথবা তাদের বৃদ্ধ, নাবালক ও অকর্মণ্য উত্তরাধিকারিগণকে জায়গীরের পরিবর্তে সুলতান ভাতা ও পেনসন দানের ব্যবস্থা করেন। তবে দিল্লীর কোতােয়াল ফখরুদ্দীনের অনুরােধে সুলতান কোনাে কোনাে জায়গীরদারকে জমি ফিরিয়ে দেন। 

যা হােক, সুলতান বলবন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন। তিনি অভিজ্ঞ ও বিশ্বাসী মালিকদের অধীনে পদাতিক ও অশ্বারােহী বাহিনীকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করেন। তিনি ইমাদুল মুলককে "দিউয়ান-ই-আরজ”-এর দায়িত্বে নিয়ােগ করেন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা প্রয়ােগ করে তিনি সৈন্যবাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তােলেন। এভাবে সংগঠিত সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বলবন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ ও প্রতিহত করতে সক্ষম হন। 

গ. গুপ্তচর প্রথা : স্বীয় স্বেচ্ছাচারিতা ও একচ্ছত্র আধিপত্য সার্থকভাবে চালু রাখার উদ্দেশ্যে এবং রাজ পরিবারের সদস্যবৃন্দ, অভিজাত সম্প্রদায় ও অন্যান্য পদস্থ রাজকর্মচারিদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে বলবন বহুসংখ্যক বিশ্বস্ত এবং অনুগত গুপ্তচর নিয়ােগ করেন। এসব গােয়েন্দা সুলতানকে বিদ্রোহের গােপন সংবাদ সরবরাহ করত। বলবনের শাসনব্যবস্থার সাফল্যের মূলে গুপ্তচরদের অসামান্য অবদান ছিল।

ঘ. বিচার ব্যবস্থা : বলবন ছিলেন ন্যায়বিচারক। তিনি স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব নীতির উর্ধে থেকে ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। সুলতানের ন্যায়বিচারের জন্য লােকে এত ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকত যে, ভৃত্য এবং ক্রীতদাসদের প্রতিও লােকে দুর্ব্যবহার করতে সাহস পেত না। বদাউনের জায়গীরদার মালিক বরবক এবং অযােধ্যার জায়গীরদার হায়বৎ খানকে হত্যার অভিযােগে অভিযুক্ত করে তিনি তাদেরকে কঠোরতম শাস্তি প্রদান করেন। এভাবে বলবন তার সুবিশাল সাম্রাজ্যে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

ঙ. রাজকোষ পুনর্গঠন : বলবন অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য রাজকোষ পুনর্গঠন করেন। রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা হয়। এর ফলে সাম্রাজ্যে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়।


অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন 

১. মেওয়াটীদের দমন : অতঃপর বলবন সাম্রাজ্যের মধ্যে বিদ্যমান সকল প্রকার অরাজকতা ও দমনে তৎপর হয়ে ওঠেন। তার শাসনামলের প্রথমদিকে মেওয়াটী (মেওয়াট বা আলােয়ারের পার্বত্য অধিবাসী) নামক রাজপুত দস্যুগণ প্রকাশ্য দিবালােকে পথিকদের সর্বস্ব অপহরণ করে নিত। এমনকি তারা দিল্লীর উপকণ্ঠে পর্যন্ত নির্বিচারে নির্ধিধায় নরহত্যা, লুটতরাজ এবং অত্যাচার কার্য চালিয়ে জনজীবন বিপন্ন করে তােলে। ভিক্ষুকের পােশাক পরিধান করে থাকলেও কেউ তাদের অত্যাচার হতে রেহাই পেত না। সুলতান বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করেন। অতঃপর তিনি শত-সহস্র মেওয়াটীদের হত্যা করে রাজধানী দিল্লী এবং তার উপকণ্ঠে শান্তি স্থাপন করেন। 

২. দোয়াবের বিদ্রোহ দমন : এর পর বলবন দোয়াবের দুর্ধর্ষ হিন্দুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তারা বাংলাদেশের সাথে দিল্লীর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করত এবং দোয়াব অঞ্চলে বেআইনী কার্যকলাপ পরিচালনা করে জনজীবন বিপন্ন করে তুলেছিল। বলবন কাম্পিল, পাতিওয়ালা ও ভােজপুরে অবস্থিত তাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলাে অধিকার করে সেখানে দুর্গ নির্মাণ করেন। এভাবে বলবন দোয়াবের বিদ্রোহীদেরকে দমন করেন এবং বাংলাদেশ হতে দিল্লী পর্যন্ত সড়কপথের নিরাপত্তা বিধান করেন। 

৩. উপজাতীয়দের বিদ্রোহ দমন : অতঃপর সুলতান বলবন জুধ পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয়দের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেন। রােহিলাখণ্ডের (কাথিয়ারের) হিন্দুগণ বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করলে বলবন তাদেরকেও সমুচিত শাস্তি প্রদান করেন। অন্যান্য ছােটখাট বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলাও যথাসময়ে দমন করা হয়। 

৪. চল্লিশচক্রের বিদ্রোহ দমন : সুলতান ইলতুৎমিশ ক্রীতদাসদের মধ্য হতে যে চল্লিশজন বিশ্বস্ত ও সুযােগ্য ক্রীতদাসকে সংঘবদ্ধ করে একটি চল্লিশচক্র (শামসী ক্রীতদাস) গঠন করেছিলেন, তারা ইলতুৎমিশের দুর্বল উত্তরাধিকারী সুলতানদের শাসনামলে রাজ্যের মধ্যে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। তারা রাষ্ট্রীয় জমিজমা ভােগ-দখল করা ছাড়াও অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা উপভােগ করত। তাদেরই অন্যতম সঙ্গী বলবন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে তারা তার পতন ঘটাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বলবন তাদের জঘন্য ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তাদের বিশেষ সুবিধা বাতিল করে, অবাধ মেলামেশা বন্ধ করে, রাজদরবারে হাসি-ঠাট্টার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে জায়গীরদারী বাতিল করে এবং সামান্য অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে তাদের (অভিজাত শ্রেণির) ক্ষমতা খর্ব করেন। 

উপরিলিখিত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করে বলবন সমগ্র সালতানাতে সংহতি আনয়ন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা বিধান করতে সক্ষম হন। ফলে সাম্রাজ্য পূর্বাপেক্ষা অনেক শক্তিশালী ও সুসংহত হয়।


বলবনের মােঙ্গল নীতি 

বলবনের রাজত্বকালে মােঙ্গলগণ বারবার ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে হামলা পরিচালনা করে সুলতানকে বাতিব্যস্ত করে তুলত। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যকে বিপদমুক্ত করার সাথে সাথে সুলতান মােঙ্গল আক্রমণের হাত হতে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। 
  • প্রথমত, তিনি বৃদ্ধ সৈনিকদেরকে সেনাবাহিনী হতে ক্রমান্বয়ে ছাঁটাই করে সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন এবং তাদেরকে উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত করেন। 
  • দ্বিতীয়ত, সামরিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলােতে সুলতান নতুন দুর্গ নির্মাণ এবং পুরাতন দুর্গগুলাে পুননির্মাণ করেন। 
  • তৃতীয়ত, সামানা, মুলতান এবং দিপালপুরকে নিয়ে সুলতান সীমান্তবর্তী প্রদেশ গঠন করে সুদক্ষ শাসনকর্তাদের উপর সেগুলাের শাসনভার অর্পণ করেন। 
  • চতুর্থত, বলবন নতুন রাজ্য-বিজয়-নীতি পরিহার করেন এবং কখনও দূরবর্তী এলাকায় যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করতেন না। মােঙ্গলদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার উদ্দেশ্যে তিনি সদা-সর্বদা রাজধানীতেই অবস্থান করতেন। প্রথমে চাচাতাে ভাই শের খানকে এবং শের খানের মৃত্যুর পর স্বীয় পুত্র মুহম্মদকে বলবন মুলতান ও দিপালপুরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানের উপর বলবন সামানা ও সুসানের শাসনভার অর্পণ করেন। 
ইতিমধ্যে ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গলগণ শতদ্রু নদী অতিক্রম করে লুটতরাজ আরম্ভ করলে শাহজাদা মুহম্মদ, শাহজাদা বুঘরা খান এবং দিল্লীর মালিক মােবারক যৌথভাবে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করে ভারতবর্ষ ত্যাগে বাধ্য করেন। তবে ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে তামারের নেতৃত্বে মােঙ্গলগণ পাঞ্জাব আক্রমণ করলে যুবরাজ মুহম্মদ তাদের সাথে সংঘটিত এক সংঘর্ষে নিহত হন। এ দুঃসংবাদে বলবন শােকাহত হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও সসৈন্যে মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাদের নিকট হতে লাহাের পুনরুদ্ধার করেন। 

বস্তুত মােঙ্গল আক্রমণের ভীতি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে। তিনি মােঙ্গল আক্রমণের গতি-প্রকৃতি ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার অথবা নতুন রাজ্য বিজয়ে উৎসাহিত হওয়ার পরিবর্তে মােঙ্গল হামলা মােকাবেলার জন্য বেশি সচেষ্ট ছিলেন। সম্ভবত তিনি ইতােপূর্বে মােঙ্গলদের হাতে বাগদাদ ধ্বংসের করুণ পরিণতি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁর অনুসৃত মােঙ্গল নীতি ও গৃহীত ব্যবস্থাবলি সাময়িকভাবে হলেও সাম্রাজ্যকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিল। 


বাংলার বিদ্রোহ 

বাংলার লােকেরা সুযােগ পেলেই বিদ্রোহী হয়ে উঠত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করত। বলবনের বার্ধক্য এবং মােঙ্গল আক্রমণের সুযােগ নিয়ে ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের শাসনকর্তা তুঘ্রিল খান বিদ্রোহী হন। তিনি ‘সুলতান মুঘিসউদ্দিন’ উপাধি ধারণ করে এবং স্বীয় নামে খুতবা পাঠের আদেশ প্রদান ও মুদ্রাঙ্কন করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। আমীর খানের নেতৃত্বে প্রেরিত এবং মালিক তারঘীর নেতৃত্বে প্রেরিত অভিযান দুটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে সুলতান বলবন সসৈন্যে তুম্রিলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। বলবনের আগমনের সংবাদে তুঘ্রিল রাজধানী লক্ষ্মণাবতী ত্যাগ করে প্রথমে সােনারগাঁ এবং পরে উড়িষ্যা অভিমুখে পলায়ন করেন। বলবন শেষ পর্যন্ত তার পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে গ্রেফতার ও হত্যা করেন (১২৮১ খ্রি.)। অতঃপর বলবন তার দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানকে বাংলাদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করেন। 


সুলতান বলবনের মৃত্যু

সুযােগ্য পুত্র প্রথম মুহম্মদ ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার সময় অকাল মৃত্যুবরণ করলে অশীতিপর বৃদ্ধ সুলতান বলবন এতই শােকাভিভূত হয়ে পড়েন যে অল্পদিনের মধ্যে তিনি ভগ্নহৃদয়ে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে বলবন দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করতে চাইলে বুঘরা খান উক্ত গুরুদায়িত্ব বহনে অনিচ্ছা জ্ঞাপন করায় সুলতান মুহম্মদের পুত্র কায়খসরুকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করে যান।


গিয়াসউদ্দিন বলবনের কৃতিত্ব

ক্রীতদাস, মশকবাহক, শিকারী, সেনাধ্যক্ষ, রাজনীতিবিদ এবং সুলতান বলবন দিল্লীর সুলতানদের দীর্ঘ তালিকায় সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসে বলবন নিঃসন্দেহে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন।

বলবনের ৪০ বছরের জীবন ছিল অধ্যবসায় ও সংগ্রামে পরিপূর্ণ, তিনি মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী ছিলেন। তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা হতে এবং দুর্ধর্ষ মােঙ্গলদের হাত হতে সব প্রতিষ্ঠিত তুর্কি সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করেন। তার সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি পরিহার তার দুর্বলতার স্বাক্ষর বহন করে না। ভারতীয় উপমহাদেশের তদানীন্তন পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি পরিহার করে বলবন লােকক্ষয় ও অৰ্থক্ষয়ের হাত হতে দেশকে রক্ষা করে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। এতে সুলতানের কূটনীতিজ্ঞানেরও পরিচয় পাওয়া যায়। গর্বিত ও ক্ষমতাশালী অভিজাত সম্প্রদায়কে কঠোর হস্তে দমনপূর্বক তাদের ও প্রজাবর্গের মনে রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার করে এবং রাজার মর্যাদা বৃদ্ধি করে সুলতান তুর্কি শাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবে রক্তপাত ও কঠোরনীতি প্রয়ােগ করে বলবন বিচ্ছিন্ন সাম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেন। শান্তিভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে বলবন শিশু তুর্কি রাষ্ট্রকে বহু বিপদের হাত হতে রক্ষা করেন। 

বলবন হাসিঠাট্টা বিবর্জিত পারসিক কায়দায় রাজদরবার ও রাজপ্রাসাদ সুসজ্জিত করেন। রাজকীয় মর্যাদা বৃদ্ধিকল্পে দায়িত্বপূর্ণ সরকারি কাজে তিনি কেবল সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবংশজাত লােকদের নিযুক্ত করতেন। ইলবারী তুর্কি হলেও তিনি নিজেকে শাহনামা বর্ণিত তুরানের বিখ্যাত সমরনায়ক আফরাসিয়াবের বংশধর বলে পরিচয় প্রদান করতেন।

বলবন নিজেকে “আল্লাহর প্রতিনিধি” মনে করে শরীয়তের নিয়মনীতি অনুসরণ, দুর্নীতি দমন, ধার্মিক ও উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে রাজকার্যে নিয়ােগ করেন এবং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসননীতি শক্তি, সম্মান ও সুবিচারের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। অপরাধীদের প্রতি তিনি অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম হলেও সমসাময়িক বিশ্বে তিনি দয়ালু, উদার ও সুদক্ষ শাসক এবং নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। বিশ্বস্ত গুপ্তচর বাহিনীর সাহায্যে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য সগ্রহ করে বলবন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সমাধান করতেন। বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বলবন তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিও পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন নি।বিজিত রাজ্যের সংহতি বিধান ও সকল বিশৃঙ্খলার মূলােৎপাটন করে তিনি একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন, যা পরবর্তী রাজ্য সম্প্রসারণে সহায়ক হয়।

মােঙ্গালদের ধ্বংসলীলা এবং বিভীষিকার মধ্যে সমসাময়িককালে একমাত্র বলবনের রাজদরবারই ছিল রাজ্যহারা ভাগ্যাহত রাজা, যুবরাজ ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণের আশ্রয়স্থল। মধ্য-এশিয়ার তুর্কিস্তান, ট্রান্সঅক্সিয়ানা, পারস্য, খাওয়ারিজম, গজনী প্রভৃতি ১৫টি দেশ হতে বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ও রাজন্যবর্গের আগমনে বলবনের রাজদরবার অপরূপ মহিমা ও গেীরবে মণ্ডিত হয়ে ওঠে। এভাবে ভারতের বাইরেও বলবন ‘মুসলিম সভ্যতার রক্ষক' হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এতদ্ব্যতীত 'ভারতের তােতা পাখি' নামে পরিচিত আমীর খসরু বলবনের রাজদরবারকে অলংকৃত করেন এবং তাঁর পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন। এক কথায়, বলবনের শাসনামলে দিল্লী মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

সংক্ষেপে বলবনের উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে এই যে - 
  • (ক) তিনি তুর্কি সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করে তাকে নবজীবন দান করেন; 
  • (খ) সালতানাতের (রাষ্ট্রশক্তির) গৌরবও তিনি পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন; 
  • (গ) সাম্রাজ্যের সর্বত্র অব্যাহত শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করে সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথ উন্মুক্ত করেন। 
  • (ঘ) তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে মােঙ্গল হামলা হতে নিরাপত্তা বিধানকল্পে এক নতুন নীতির প্রবর্তন করেন। 
এসব দিক পর্যালােচনা করলে বলবনকে “সালতানাতের প্রকৃত সংরক্ষণকারী” হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। বলবন এমন একজন ক্ষণজন্মা শাসক ছিলেন যিনি ভারতের শিশু মুসলিম রাষ্ট্রকে মােঙ্গলদের প্রলয়ংকরী আক্রমণের হাত হতে রক্ষা করেন এবং সমাজব্যবস্থার সুষম বিন্যাস দ্বারা আলাউদ্দিন খলজীর সামরিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের পথকে সুগম করেন।”


গিয়াসউদ্দিন বলবনের চরিত্র

সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও নিষ্কলুষ চরিত্রের এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। প্রথম জীবনে তিনি মদ্যপানে অভ্যস্ত থাকলেও সুলতান হওয়ার পর তিনি তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বদায়ূনী বলেন, “বলবন ঐকান্তিকতার সাথে সকল নামাজের জামাতে শরীক হতেন এবং কখনও বিনা অজুতে থাকতেন না।” পীর-কামেল ও বুজর্গ ব্যক্তিগণের কবর তিনি প্রতি শুক্রবার জিয়ারত করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি সাধু পুরুষদের উৎসাহ ও সকল প্রকার মদদ প্রদান করতেন। সাম্রাজ্যে তিনি অসামাজিক ও ইসলাম-বিরােধী কার্যকলাপ বন্ধ করে দেন। 

ব্যক্তিগত জীবনে বলবন ছিলেন স্নেহশীল পিতা এবং দয়ালু শাসক। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ মুহম্মদের মৃত্যুর শোকেই তিনি প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যায়কারী ও দুষ্কৃতিকারীদের প্রতি তিনি নিষ্ঠুর হলেও দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। এক কথায় , সুলতান বলবন শিষ্ঠাচারে কঠোর, হত্যাকার্যে নির্দয়, শাস্তি প্রদানে ভয়াল এবং জাকজমক ও আড়ম্বরপূর্ণ রাজদরবার কায়েম করেছিলেন বলে প্রজাবর্গ তাকে যমের মত ভয় করত এবং পারিষদবর্গ সুলতানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। সালতানাতের সংহতি ও অখণ্ডতা বিধানকল্পে বাধ্য হয়ে সুলতানকে তরবারি ও চক্রান্তের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে বলবন একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তিনি দিল্লীর সালতানাতের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং জনগণকে শান্তি প্রদান করেন।


গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসননীতির সমালােচনা

সুদীর্ঘ ৪০ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা বলবন দিল্লী সালতানাতকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন সত্য, তবে তাঁর অনুসৃত নীতিগুলাে তথাকথিত দাসবংশের পতনের মূলে অনেকাংশে দায়ী ছিল বলে অনেকে মনে করেন। 
  • প্রথমত, তার শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে একনায়কত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। শাসনবিভাগের সর্বপ্রধান উৎস এবং সাম্রাজ্যের সব বিভাগের সর্বময় কর্তা ছিলেন তিনি। তার ক্ষমতার কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু তিনি যে আমীর-মালিকগণের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তারাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং এ বংশের পতনকে ত্বরান্বিত করে। 
  • দ্বিতীয়ত, সুলতান “বন্দেগান-ই চেহেলগানের" ক্ষমতা হ্রাস করে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের মূলে কুঠারাঘাত করেন। সুযােগ্য সুলতানের অভাবে এ সকল বিশ্বস্ত দাসগণই সাম্রাজ্যকে হয়ত বা রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকেও সুলতান বলবন বিনষ্ট করে দিয়েছিলেন। 
  • তৃতীয়ত, শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠনে বলবন কোনাে প্রকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি। প্রাদেশিক শাসন ও রাজস্ব আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা তিনি প্রবর্তন করতে পারেন নি বলে প্রশাসনিক সঙ্কট দেখা দেয়। ফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বলবনের শাসনকার্যে অদূরদর্শিতাও তথাকথিত দাসবংশের পতনের জন্য কম দায়ী ছিল না। 
  • চতুর্থত, বলবন তুর্কি জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ করে স্থানীয় অধিবাসীদেরকে এমনকি স্থানীয় মুসলমানদেরকেও নীচ বংশােদ্ভূত বলে ঘৃণা করতেন। এ নীতির ফলে তুর্কি গােষ্ঠীভুক্ত স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি সাম্রাজ্যে সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন। অপরপক্ষে ভারতীয় মুসলমানগণের মধ্যে সুলতানের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি ও বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ বলবনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই স্থানীয় মুসলিম শক্তির প্রতিভূস্বরূপ খলজী বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। এ বিপ্লব কিছুকালের মধ্যেই বলবনের তুর্কি জাতীয়তাবাদী নীতিকে ধ্বংস করে তথাকথিত দাসবংশেরও পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়।
এতদ্সত্ত্বেও সুদক্ষ যােদ্ধা, সুযােগ্য শাসক এবং রাজনীতিবিদ বলবন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে শিশু মুসলিম রাষ্ট্রকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষাকারী হিসেবে মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকবেন। তিনি সুলতান আলাউদ্দিনের অগ্রদূত ছিলেন।

তথ্যসূত্র : 
বই : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : হাসান আলী চৌধুরী

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন