শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ এর জীবনী - Biography of Shamsuddin Iltutmish


শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ এর প্রাথমিক জীবন 

ইলতুৎমিশ (আলতামাশ, আলতুতমিশ) ছিলেন তুর্কিস্তানের বিখ্যাত ইলবারী গােত্রের ইয়ালম খানের পুত্র। ইলতুৎমিশের বুদ্ধিমত্তা, চাতুর্য ও সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ভ্রাতৃগণ চক্রান্ত করে তাকে জনৈক ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর নিকট বিক্রয় করেন। উক্ত ব্যবসায়ী ইলতুৎমিশকে বােখারার কাজীর নিকট বিক্রয় করেন। অতঃপর জামাল উদ্দিন নামক আর একজন ক্রীতদাস ব্যবসায়ী তাকে কাজীর নিকট হতে ক্রয় করে দিল্লীতে নিয়ে আসলে কুতুবউদ্দিন তাকে ক্রয় করেন। কুতুবউদ্দিন তার দৈহিক সৌন্দর্য, প্রতিভা, জ্ঞান, বিশ্বস্ততা এবং বিচক্ষণতায় বিমুগ্ধ হয়ে নিজ কন্যার সাথে তার বিবাহ দেন এবং ইলতুৎমিশকে “আমীর-ই-শিকার” পদে নিযুক্ত করেন। এরপর ইলতুৎমিশ যথাক্রমে গােয়ালিয়র, বারান এবং বদাউনের শাসনকর্তা পদে নিয়ােজিত থাকেন। আরাম শাহকে পরাজিত করে আমীর- উমরাহগণের অনুরােধক্রমে তিনি দিল্লীর মসনদে আরােহণ করেন। তাঁর সিংহাসনারােহণের সাথে সাথে দাসবংশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সংযােজিত হয়।


সাম্রাজ্যের সমস্যাবলি ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন 

ক্ষমতা লাভ করে ইলতুৎমিশ এক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। এ সময় -
  1. গজনীর তাজউদ্দিন ইয়লদুজ হিন্দুস্তানের সর্বময় কর্তা হবার দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন। 
  2. মুলতানের শাসনকর্তা নাসির উদ্দিন কুবাচা নিজেকে স্বাধীন বলে ঘােষণা করে ভাতিন্দা, গুহরাম ও সারসুতী এলাকায় স্বীয় প্রাধান্য বিস্তার করেন। তিনি পাঞ্জাব অধিকার করার জন্য অগ্রসর হন। 
  3. আজমীর, গােয়ালিয়র এবং দোয়াব অঞ্চল সুলতানের অধীনতা অস্বীকার করে বসে।
  4. মুঈজী ও কুতবী আমীর বলে পরিচিত আমীরগণও ইলতুৎমিশের বিরােধিতা করতে আরম্ভ করেন। 
  5. এ সুযােগে বাংলা ও বিহারের শাসনকর্তা আলী মর্দানও নিজেকে স্বাধীন বলে প্রচার করেন। 
  6. পরিশেষে সুলতানকে মােঙ্গল হুমকির সম্মুখীনও হতে হয়। 
উপরােক্ত সমস্যাবলির সম্মুখীন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা বিব্রত ও পরিবেষ্টিত হয়েও ইলতুৎমিশ নিরুৎসাহ হবার পাত্র ছিলেন না। তিনি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় এবং আপােসহীন মনােভাব নিয়ে দিল্লীর মসনদে তার অবস্থানকে সুদৃঢ় করার নিমিত্ত আত্মনিয়ােগ করেন।


আমীর ও তুর্কিবাহিনীর আনুগত্য লাভ 

সর্বপ্রথম তিনি দিল্লীর উপকণ্ঠে জুধ নামক স্থানে বিক্ষুদ্ধ মুঈজী ও কুতবী আমীরগণকে এক সংঘর্ষে পরাজিত করে দিল্লী ও পার্শ্ববর্তী অযােধ্যা, বেনারস, বদায়ুন, সিউয়ালিক প্রভৃতি অঞ্চলের উপর নিজের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর সুলতান লাহােরে অবস্থানরত তুর্কিবাহিনীর আনুগত্য ও সমর্থন লাভেও সক্ষম হন। 


তাজউদ্দিন ইয়লদুজের পতন

এরপর সুলতান ইলতুৎমিশ গজনীর শাসনকর্তা তাজউদ্দিন ইয়লদুজের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে ইয়লদুজ খাওয়ারিজমের শাহ আলাউদ্দিন মুহম্মদ কর্তৃক গজনী হতে বিতাড়িত হলে তিনি ভারতে আগমন করে পাঞ্জাব হতে থানেশ্বর পর্যন্ত এক বিরাট এলাকার উপর স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। এটা ইলতুৎমিশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে পঁড়লে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের সন্নিকটে তরাইনের যুদ্ধে সুলতান ইয়লদুজকে পরাজিত ও বন্দী করেন। বন্দী অবস্থায় ইয়লদুজ বদায়ুনের কারা মৃত্যুবরণ করেন। এ বিদ্রোহ দমনের ফলে দিল্লী সাম্রাজ্যের উপর ইলতুৎমিশের কর্তৃত্ব অনেকাংশে নিষ্কণ্টক হয়। 


নাসির উদ্দিন কুবাচার পতন 

উচ ও মুলতানের শাসনকর্তা নাসির উদ্দিন কুবাচা স্বাধীনতা ঘােষণা করে লাহাের পর্যন্ত অগ্রসর হলে ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন এবং তাকে পরাজিত করে লাহাের হতে বহিষ্কার করেন। অতঃপর কুবাচা সিন্ধুর ভাক্কারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে কুবাচা পুনরায় বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ভাক্কারের সন্নিকটে সংঘটিত এক যুদ্ধে ইলতুৎমিশ তাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। পলায়নকালে কুবাচা সিন্ধু নদীতে ডুবে প্রাণ হারান। এরূপে সুলতান ইলতুৎমিশ তার উপরােল্লিখিত দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপসারিত করে রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে স্বীয় কর্তৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। 


চেঙ্গিস খানের আক্রমণ হতে অব্যাহতি লাভ

সুলতান ইলতুৎমিশের শাসনামলে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলগণের ভারত আক্রমণ ইতিহাসের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ১২২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক বিশাল শক্তিশালী মােঙ্গল বাহিনী নিয়ে খাওয়ারিজম আক্রমণ করলে খাওয়ারিজমের যুবরাজ জালালউদ্দিন পলায়ন করে পাঞ্জাবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। চেঙ্গিস খান তার পশ্চাদ্ধাবন করে সিন্দুদেশ পর্যন্ত অগ্রসর হন। অতঃপর জালালউদ্দিন দিল্লীর রাজসভায় দূত মারফত আশ্রয় প্রার্থনা করলে বাস্তববাদী ও কূটকৌশলী ইলতুৎমিশ “ভারতের আবহাওয়া তার স্বাস্থ্যের অনুকূল হবে না”—এ অজুহাতে তাকে আশ্রয়দানে অস্বীকৃতি জানান। ফলে জালালউদ্দিন পারস্যের দিকে যাত্রা করেন। অপরপক্ষে , চেঙ্গিস খানও অল্পদিন পরেই ভারত ত্যাগ করে সসৈন্যে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এভাবে ইলতুৎমিশ কূটকৌশলে শিশু মুসলিম রাষ্ট্রকে এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত হতে রক্ষা করেন। 

বাংলা পুনরাধিকার 

সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের ইন্তিকালের পর দিল্লী সাম্রাজ্যের গােলযােগ ও বিশৃঙ্খলার সুযােগ নিয়ে আলী মর্দান খলজী বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ১২১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হলে হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খলজী ‘সুলতান গিয়াসউদ্দিন' উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি বিহার অধিকার করেন এবং জাজনগর (উড়িষ্যা) , ত্রিভুত, মধ্যবঙ্গ ও কামরূপ হতে কর প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি লাভ করেন। তিনি স্বীয় নামে খুতবা পাঠের এবং মুদ্রা প্রচলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়াও সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। তার এহেন কার্যকলাপে বিব্রত হয়ে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে তিনি বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করেন এবং সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করেন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন পুনরায় বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ইলতুৎমিশ তার পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে বঙ্গদেশ আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। তিনি গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত ও হত্যা করলে সুলতান তাকে বঙ্গদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মৃত্যুমুখে পতিত হলে বাংলাদেশের খিলজিগণ মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন বলকার নেতৃত্বে পুনরায় স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। অতঃপর ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ সসৈন্য অগ্রসর হয়ে বলকা খলজীকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলাদেশকে সরাসরি দিল্লী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।


ইলতুৎমিশ এর রাজ্য জয় 

অভ্যন্তরীণ সংকট এবং বহিঃশক্তির আক্রমণের দুর্যোগ হতে নিজের অবস্থার সংহতি সাধন করে ইলতুৎমিশ হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ব্রতী হয়ে ১২২৬ খ্রিস্টাব্দে রণথম্ভোর এবং পরের বছর সিওয়ালিক পর্বতে অবস্থিত মান্দাওয়ার দখল করেন। এক বছর অবরােধের পর ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি গােয়ালিয়র অধিকার করেন। ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে মালবের রাজা মজলদেবের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে সুলতান ভিলসা ও উজ্জয়িনী দখল করেন। সুলতান তার সর্বশেষ অভিযান প্রেরণ করেন দোয়াব অঞ্চলের হিন্দু বেনিয়াদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় সুলতানকে তাঁর এ অভিযান পরিত্যাগ করতে হয়। 

অতঃপর সগৌরবে ২৫ বছর রাজত্ব করার পর ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশ মৃত্যুমুখে পতিত হন। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তিনি তার সুযােগ্য কন্যা রাজিয়াকে সিংহাসনে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারিণী মনােনীত করে যান।


খলিফার নিকট হতে খেতাব লাভ 

প্রথমত, মুসলিম জগতে সম্মান ও শক্তি বৃদ্ধিকল্পে; দ্বিতীয়ত, প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিকট উচ্চস্থানের অধিকারী হবার মানসে এবং তৃতীয়ত, আইনসম্মত শাসক হবার উদ্দেশ্যে ইলতুৎমিশ ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহর নিকট হতে ‘সুলতান-ই-আজম” (শ্রেষ্ঠ সুলতান) খেতাব লাভ করেন। এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে তার কূটনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। 


ইলতুৎমিশের শাসনব্যবস্থা 

মুহম্মদ জুনাইদি এবং ফখরুল মুলকের পরামর্শ ও সহযােগিতায় ইলতুৎমিশ দিল্লী সালতানাতের প্রশাসনিক ভিত্তি রচনা করেন। তিনি কেন্দ্রে বিভিন্ন দপ্তর স্থাপন করে সেগুলােতে নিয়মিতভাবে হিসাবপত্র ও অন্যান্য বিষয়ে বিবরণ রাখার ব্যবস্থা করেন। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থা এবং অর্থ পরিদপ্তরের পুনর্গঠন করেন। সমগ্র সাম্রাজ্যকে তিনি কতকগুলাে ‘ইকতা'য় বিভক্ত করে ইকতাদারগণকে স্ব স্ব ইকতায় শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার এবং রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়ােজিত করেন। ইকতাদারগণ তাদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয়ভার বাবদ অর্থ রেখে উদ্বৃত্ত রাজস্ব কেন্দ্রে প্রেরণ করতেন। প্রয়ােজনবােধে ইকতাদারগণকে বদলি করার ব্যবস্থারও তিনি প্রবর্তন করেন। যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে তিনি বহু রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং বনজঙ্গল অপসারণ করেন। তিনি তার দরবারে একটি শিকলে বাঁধা ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ এটা বাজিয়ে ন্যায়বিচারের জন্য সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। 

ভারতীয় উপমহাদেশের দিল্লীর সুলতানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রবর্তন করেন। তা রূপাইয়া নামে অভিহিত হতাে। একটি স্টান্ডার্ড মানের রূপাইয়ার ওজন ছিল ১৭৫ গ্রেন।

প্রাথমিক তুর্কি সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান ইলতুৎমিশ অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন সুলতান ছিলেন। তিনি ছিলেন আদর্শবাদী, সচ্চরিত্রবান, ধার্মিক, উদার, সুবিচারক এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক। সে যুগের শ্রেষ্ঠ আউলিয়া বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, শেখ জালালউদ্দিন তাব্রিজী ও খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়। ঐতিহাসিক মিনহাজ-উস-সিরাজ ও আওফি এবং কবি রুহানী ও মালিক তাজ-উদ-দীন- রেজাব প্রমুখের তিনি পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার শাসনকালে মধ্য এশিয়া থেকে বহু পীর আউলিয়া ভারতবর্ষে এসে ইসলাম প্রচার করেন। 

স্থাপত্য ও শিল্পকলারও তিনি একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় দিল্লীর বিখ্যাত “কুতুব মিনার, আজমীরের ‘আড়াই-দিন-কা-ঝােপড়া', বদাউনে একটি বৃহৎ ঈদগাহ, দিল্লীতে নাসিরিয়া মাদ্রাসা এবং রাজ্যে অসংখ্য রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মিত হয়। তার শাসনামলে দিল্লী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল এবং তুর্কি সাম্রাজ্য উন্নতি ও গৌরবের উচ্চশিখরে আরােহণ করেছিল। তার রাজত্বকাল সমৃদ্ধিশালী ও গৌরবময় ছিল এবং তার রাজত্বকাল গত হওয়ার পরও মানুষ তার কথা স্মরণ করত। 

ইলতুৎমিশ কুতুবউদ্দিন হতে শতগুণে অধিক দানশীল ছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তাকে “আল্লাহর বান্দাগণের সাহায্যকারী” (the helper of the servants of God) এবং “আল্লাহর রাজ্যের রক্ষক” (a protector of the lands of God) বলে আখ্যায়িত করেছেন।


ইলতুৎমিশ এর চরিত্র ও কৃতিত্ব

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিনের ক্রীতদাস হিসেবে জীবন শুরু করে মাত্র দু দশকের মধ্যে ভারতবর্ষে তুর্কি সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরােহণ করে ইলতুৎমিশ ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছেন। তিনি ছিলেন সুচতুর, নির্ভীক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। একমাত্র আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত দিল্লী সালতানাতকে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর হাত হতে শুধু রক্ষাই করেননি, তিনি সুলতানী সাম্রাজ্যের ভিত্তি ও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ভিত্তিও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। “বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের আদর্শ জনগণের তথা শাসকগােষ্ঠীর মনে এমন গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল যে, ইলতুৎমিশের পরেও ত্রিশ বছর ধরে তার বংশধরেরাই সিংহাসনে বসার একমাত্র অধিকারী বলে বিবেচিত হয়েছিল।" বস্তুত তিনিই ছিলেন দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। 

ইলতুৎমিশ বিরুদ্ধবাদী আমিরগণকে তার কর্তৃত্ব স্বীকারে বাধ্য করেন এবং তাজউদ্দিন ইয়লদুজ ও নাসিরউদ্দিন কুবাচার দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হন। অতঃপর কঠোর হস্তে বাংলার বিদ্রোহ দমন করে তিনি রাজপুতদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ এবং হৃত রাজ্যগুলাে পুনরুদ্ধার করেন। এরপর সুলতান নতুন রাজ্য জয় করে দিল্লী সালতানাতের পরিসর বৃদ্ধি করেন। খাওয়ারিজমের শাহ জালালউদ্দিনকে দিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। এভাবে ইলতুৎমিশ ভারতীয় উপমহাদেশের তুর্কি সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে মুহম্মদ ঘুরী ও কুতুবউদ্দিন আইবেকের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করেন। 

ইলতুৎমিশই ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুসলিম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা। ভারতে সর্বপ্রথম একটি সুপরিকল্পিত রাজধানী, একটি স্বাধীন রাজ্য, একটি রাজতন্ত্রসম্মত সরকার এবং ৪০ জন তুর্কি ক্রীতদাসের সমন্বয়ে 'বন্দেগান-ই-চহেলগান' নামে অভিহিত শাসকগােষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই এ উপমহাদেশে বিচ্ছিন্ন মুসলিম শাসিত অঞ্চলগুলােকে সংঘবদ্ধ করে দিল্লীর সুলতানী সাম্রাজ্যের ভিত্তি রচনা করেন। 

মূলত কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লীর সালতানাত এবং তার সার্বভৌম মর্যাদার রূপরেখা প্রদান করেন; আর শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ ছিলেন প্রশ্নাতীতভাবে তার প্রথম রাজা।

তথ্যসূত্র : 
বই : পৌরনীতি ও সুশাসন। 
লেখক : প্রফেসর মোঃ মোজাম্মেল হক

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন