ছয় দফা আন্দোলন - Six Point Movement

ছয় দফা আন্দোলন - Six Point Movement - Bongo Tweet
ছবি: daily-sun.com

বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন ছিল একটি মাইলফলক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাঁচামালের যােগানদাতা হিসেবে পরিণত হয়। পাকিস্তানের সমস্ত মিল, কলকারখানা ও ব্যাংক-বীমার মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তানে যেসব শিল্প কলকারখানা স্থাপিত হয়েছিল সেগুলােরও মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। এসব শিল্প কলকারখানায় যে লাভ হতাে তা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যেত। এমনকি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বাঙালিরা চরম নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ছিল। 

এ অবস্থার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলাে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একত্রিত হওয়া শুরু করে। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের এক কাউন্সিল অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। উক্ত অধিবেশনে শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি লাহােরে বিরােধী দলগুলাের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের বাঁচার দাবি ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কর্তৃক লাহাের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল, সেখানেই স্বাধীন বাংলার বীজ বপনের ভিত্তিস্বরূপ ছয় দফা ঘােষণা করা হয়। ফরাসি জাতির নিকট যেমন “ফরাসি বিপ্লব”, ইংল্যান্ডের নিকট যেমন “ম্যাগনাকার্টা”, আমেরিকার নিকট “স্বাধীনতা যুদ্ধ” তেমনি বাংলাদেশের নিকট “ছয় দফা” একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে পরিচিত। নিম্নে ছয় দফা কর্মসূচিগুলাে আলােচনা করা হলাে : 

১.শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে

ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্রীয়রূপে গড়তে হবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। সকল নির্বাচন সর্বজনীন ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাসমূহ হবে সার্বভৌম।

২.কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা 

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত ক্ষমতা থাকবে। অবশিষ্ট সকল ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্য তথা প্রদেশগুলাের হাতে। 

৩.মুদ্রা ও অর্থবিষয়ক ক্ষমতা

এই দফাগুলাে সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল এবং এর মধ্যে যে-কোনাে একটি গ্রহণের দাবি করা হয়। প্রস্তাব দুটি নিম্নরূপ :
  • পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। দুটি অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র State Bank থাকবে। 
  • দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন এক সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান হতে মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। 

৪.রাজস্ব কর ও শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা

সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের থাকবে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়যােগ্য অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেল সরকারের তহবিলে জমা হবে। এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকবে। এভাবে জমাকৃত অর্থ নিয়ে ফেডারেল সরকারের তহবিল গঠিত হবে। 

৫.বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা

এ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে কতিপয় শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশগুলাে হলাে : 
  • দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব রাখতে হবে। 
  • পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে। 
  • ফেডারেশনের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল হতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারে আদায় হবে। 
  • দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি রপ্তানি করা চলবে। 
  • ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন এবং আমদানি রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে এবং এজন্যে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। 

৬.আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা 

অঙ্গরাজ্যগুলােকে জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কার্যকরী অংশগ্রহণের সুযােগদান এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সংহতি রক্ষা করার সুযােগ প্রদান করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের সুযােগ ও ক্ষমতা দিতে হবে।

তথ্যসূত্র : 
বই : পৌরনীতি ও সুশাসন। 
লেখক : প্রফেসর মোঃ মোজাম্মেল হক।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন