Skip to content Skip to sidebar Skip to footer

প্রাক ইসলামি আরবের ইতিহাস - History of Pre Islami Arabia

প্রাক ইসলামি আরবের ইতিহাস - History of Pre Islami Arabia - Bongo Tweet

আরব দেশের ভৌগােলিক অবস্থান

আরব একটি ত্রিভুজাকৃতি উপদ্বীপ। এ দেশ তিনদিকে জল এবং এক দিকে স্থল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ জন্য আরব দেশকে আরবি ভাষায় 'জাজিরাতুল আরব' বা আরব উপদ্বীপ বলে অভিহিত করা হয়। ইসলামের লীলাভূমি এ দেশ বিশ্বের অন্যতম 'বৃহত্তম উপদ্বীপ'। এর উত্তরে রয়েছে সিরিয়ার মরুভূমি, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পূর্বে পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে লােহিত সাগর। 

ভূতত্ত্ববিদদের মতে কোনাে এক সময় আরব বৃহৎ মরুভূমি সাহারার একটি অংশ হিসেবে পরিগণিত হতাে। কালক্রমে নীলনদ এবং লােহিত সাগর দ্বারা আরব আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুয়েজ খাল খননের ফলে এটি সম্পূর্ণভাবে আফ্রিকা মহাদেশ হতে আলাদা হয়ে যায়।


আরব নামের নামকরণ 

আরব নামের নামকরণ নিয়ে তিনটি মত রয়েছে। 
  • প্রাচীনকালে হেজাজ অঞ্চলের তায়ামা প্রদেশের কাছে 'আরাবা' নামে একটি স্থান ছিল। সেটির নামানুসারে কালক্রমে উপদ্বীপটির নাম আরব হয়েছে। 
  • দক্ষিণ আরবীয়দের কল্পিত পূর্বপুরুষ কাহতানের পুত্র ইয়ারাবের নাম থেকে আরব নামের উৎপত্তি হয়েছে। 
  • আরব শব্দটির সাথে হিব্রু ভাষার আবহার শব্দটির যথেষ্ট মিল আছে। দুটিরই অর্থ মরুভূমি। তাই আবহার শব্দ থেকেও উপদ্বীপটির নামকরণ আরব হতে পারে।


প্রাচীন আরব দেশের গুরুত্ব

প্রাচীন বিশ্বের মানচিত্রে আরব দেশ তুলনাহীন এক অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী ছিল। (আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কৃত হবার পূর্বে প্রাচীন বিশ্বের তিনটি মহাদেশ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সংযােগ কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতাে।) পাশ্চাত্য দেশগুলাের প্রাচ্যে প্রবেশের দ্বার হিসেবেও আরব দেশের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ কারণেই মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় শাসকদের আমল থেকে অদ্যাবধি এ দেশটিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোে আধিপত্য বিস্তারে সদা তৎপর।


আরব দেশের আয়তন

আরব ভূখণ্ডের আয়তন ১০,২৭,০০০ বর্গমাইল (২৬,৫৮,৭৮১ বর্গ কিলােমিটার) এবং প্রতি
বর্গমাইলে মাত্র ৭ জন লােক বাস করে। আয়তনে এটি ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ। এটি সমগ্র দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের চেয়েও বড়।


প্রাচীন আরবের ভূপ্রকৃতি

ভূপ্রকৃতি হিসেবে সমগ্র আরবকে মােটামুটি তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়; যথা উত্তর আরব, মধ্য আরব এবং দক্ষিণ আরব।
  • উত্তর আরব: উত্তর আরব প্রায়ই মরুময়। মরু অঞ্চল প্রধানত নুফুদ, দাহানা ও হাররাহ এ তিন ভাগে বিভক্ত। এ অঞ্চলের মধ্যে যেখানে মরুদ্যান রয়েছে, সেখানে স্ল্প পরিমাণ লােকালয় গড়ে উঠেছে। 
  • মধ্য আরব: মধ্য আরবে আরবের বৃহত্তম মরুভূমি দাহনার কিছু অংশ বিদ্যমান থাকলেও প্রাচীনকাল হতেই সেখানে বেশ কটি নগর পরিলক্ষিত হয়। হেজাজ, নজদ ও আন-আশা এ তিনটি প্রদেশের সমন্বয়ে মধ্য আরব গঠিত। ইতিহাস প্রসিদ্ধ মক্কা নগরী হেজাজের রাজধানী। ইয়াসরিব, তায়েফ ও জেদ্দা হেজাজের আরও তিনটি প্রধান নগর। নজদ আরবের বর্তমান সউদ বংশীয় বাদশাহদের জন্মভূমি। 
  • দক্ষিণ আরব: হাজরামাউত, ইয়েমেন ও ওমান নিয়ে দক্ষিণ আরব গঠিত। দক্ষিণ আরব অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। এ এলাকা ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কৃষিকার্যের জন্যও বিখ্যাত। ইয়েমেন শব্দের অর্থ সুখী এবং ইয়েমেন নাম হতেই উর্বর দক্ষিণ আরব সুখী আরব ভূমি বা 'সৌভাগ্য আরব' (Arabia Felix) নামে প্রাচীনকালে অভিহিত হতাে। বর্তমানে ইয়েমেন পৃথক রাষ্ট্র এবং ওমান মস্কটের সুলতানের শাসনাধীন রয়েছে।


আরবের আবহাওয়া ও উৎপন্ন দ্রব্য

আরব অন্যতম সর্বাপেক্ষা শুষ্ক এবং গরম প্রধান দেশ।
একাধিক ওয়াদি (wadi) থাকলেও সে দেশে নৌ-চলাচলের উপযােগী কোনাে নদ-নদী নেই। আরবের এক-তৃতীয়াংশ মরুময়, প্রকৃতির রূদ্র লীলাস্থল এবং মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অযােগ্য। এসব স্থান শুষ্ক, নিষ্করণ, রৌদ্রদগ্ধ ও বৃক্ষলতাদি শূন্য এবং সেখানে 'লুহ' হাওয়া প্রবাহিত হয়। হেজাজের গড় তাপমাত্রা ৭০° ফা.। কিন্তু ওমান, ইয়েমেন, তায়েফ প্রভৃতি স্থানে বছরে দুবার বৃষ্টিপাত হয়। এসব এলাকা শস্য-শ্যামলা এবং আবহাওয়া মােটামুটি ভালাে। এখানে কফি, নীল, শাক-সবজি, আতা, ডুমুর, দাড়িম্ব, পিচ, খেজুর, ইক্ষু, তরমুজ, লেবু ইত্যাদি জন্মে।


আরব দেশের জীবজন্তু ও গাছপালা

উট, ঘােড়া, ভেড়া, দুম্বা, ছাগল, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি ছিল তাদের গৃহপালিত জন্তু। আরবের বন্য জন্তুর মধ্যে হায়েনা, বাঘ, সরীসৃপ, খেঁকশিয়াল প্রভৃতি সম্বন্ধে জানা যায়। 

বাজপাখি, কবুতর, ঈগল, হুদহুদ, তিতির ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পাখি আরবে ছিল।

জীবজন্তর মধ্যে উট ও ঘােড়া এবং গাছ-গাছড়ার মধ্যে খেজুর গাছ আরববাসীদের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান।

উটকে তারা প্রাণাপেক্ষাও প্রিয় মনে করে। মরুজীবনের একমাত্র সহায় ও সম্বল উট। উট তাদের নিকট মরুভূমির জাহাজ (The ship of the desert) এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের একমাত্র বাহন হিসেবে বিবেচিত হতাে। উট অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু প্রাণী। উট শীতকালে ২৫ দিন এবং গ্রীষ্মকালে ৫ দিন পানি পান না করেও কর্মক্ষম থাকে। উটের দুধ ও মাংস ছিল তাদের প্রিয় খাদ্যদ্রব্য। উটের চামড়া দ্বারা আরববাসী পােশাক-পরিচ্ছদ তৈরি এবং লােম ও চামড়া দ্বারা তাঁবু নির্মাণ করতাে; এর মল দ্বারা জ্বালানি এবং মৃত্র দ্বারা তারা মস্তিষ্ক রােগের প্রতিষেধক ঔষধ প্রস্তুত করতাে। যুদ্ধক্ষেত্রে উট ব্যবহৃত হতাে এবং রক্তপাতের মূল্য, জুয়াখেলার পণ, বিবাহের যৌতুকও উটের বিনিময়ে প্রদত্ত হতাে। শেখের ঐশ্বর্যও উট দ্বারা পরিমাপ করা হতাে। পবিত্র কুরআনে উটকে আরববাসীর জন্য এক বিশেষ নেয়ামত বা অবদান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। [আল কুরআন ১৬ : ৫-৮]। আরবের প্রখ্যাত কবিগণ তাঁদের বিভিন্ন কবিতায় উটের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। হযরত ওমর (রা) বলেন, "উট যেখানে উন্নত, আরবরাও সেখানে উন্নত।

আরব দেশে উটের পরেই ছিল ঘােড়ার স্থান। আরবের ঘােড়া বিশ্ববিখ্যাত। খেলাধুলা, শিকার, লুটতরাজ ও
যুদ্ধ-বিগ্রহে আরববাসী ঘােড়াকে ব্যবহার করতাে। খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছর পূর্বে ঘোড়ার প্রচলন পরিদৃষ্ট হয় পশ্চিম এশিয়ায় এবং খ্রিস্টের জন্মের শুরুতেই সিরিয়া থেকে আরব দেশে ঘােড়া আমদানি করা হয়। আরবীয় ঘােড়ার প্রভুভক্তি, খ্যাতি ও বাহাদুরী সর্বজনবিদিত। ক্রুসেড আমলে বিলেতি ঘোড়া পুনরায় আরবীয় ঘােড়ার সংমিশ্রণে নতুনত্ব লাভ করে।

গাছ-গাছড়ার মধ্যে 'খেজুর গাছ আরববাসীর নিকট ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। আরব দেশে খেজুর গাছ 'queen বা রাণী' গাছ নামে সমধিক প্রসিদ্ধ। প্রায় একশত প্রকারের খেজুর আরব দেশে পরিলক্ষিত হতাে। খেজুর ছিল তৎকালীন আরববাসীর প্রধান খাদ্য। এর রস ছিল তাদের প্রিয় পানীয়। সে দেশে গৃহ নির্মাণের কাজে, মাদুর ও দড়ি তৈরি, জ্বালানি কাঠরূপে এবং বিভিন্ন প্রকারের কাজে খেজুর গাছ ব্যবহৃত হতাে। খেজুর বীজের গুঁড়া উটের জন্য এক প্রকার বিশেষ ধরনের খাদ্য ছিল। আমির-ফকির নির্বিশেষে প্রতিটি আরববাসীর অকৃত্রিম বন্ধু ছিল খেজুর। খেজুর আরববাসীর জীবন ধারণের জন্য ছিল অপরিহার্য।


আরবজাতি বা প্রাচীন আরব অধিবাসী

আরবভূমির প্রাচীন অধিবাসীদের সম্পর্কে কোনাে সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া না গেলেও এ কথা ঠিক যে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আরব দেশে বিভিন্ন জাতির লােক বসতি স্থাপন করেছিল। প্রাচীন কালদীয় জাতি যে বংশ হতে উদ্ভূত আরবের পূর্বতন অধিবাসীরাও সে বংশােদ্ভূত বলে কথিত হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে প্রাচীন জাতি ৩ ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- (১) আদিম আরব, (২) মূল আরব এবং (৩) মুস্তারব।
  • আদিম আরব: এরা ৫ ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- আদ বংশ, ছামুদ বংশ, তাছম ও জাদিম বংশ, জারহাম বংশ এবং আসালিকা বংশ। হাযরামাউতের অধিবাসী ছিল আদ বংশ। এ বংশ হুদ (আ) নবির আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ছামুদ বংশ মক্কা নগরীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরা হজরত নূহ (আ)-এর প্রপৌত্র সালেহ (আ) নবির সময় মহান আল্লাহর গজবে বিলীন হয়ে যায়। তাছম ও জাদিম বংশদ্বয় পরস্পর বিবাদ ও গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজেদের কবর রচনা করে। জারহাম বংশের বংশধররা স্বল্পকালের মধ্যে অযােগ্যতার কারণে আরব ভূখণ্ড থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আসালিকা বংশ প্রাচীন আরবে একটি শক্তিশালী সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। তারা দক্ষিণ মিশরও অধিকার করে সেখানে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এদের দলপতি ওয়ালিদই সর্বপ্রথম ফেরাউন নামের উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে এদের কোনাে বংশধরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। 
  • মূল আরব: মূল বা আদি আরবগণ ছিল কাহ্তানের বংশধর। কাহতানের জারহাম ও ইয়ারব নামক দুই পুত্র ছিল। জারহাম ছিলেন হেজাজের এবং ইয়ারব ছিলেন ইয়ামানের শাসক। ইয়ারবের দুই প্রপৌত্র হাপীর ও খালান এবং তাদের বংশধরগণ মহানবির (স) জন্মের ৭০ বছর পূর্ব সময়কাল পর্যন্ত ইয়ামানের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। 
  • মুস্তারব: বহিরাগতরা ইতিহাসে মুস্তারব নামে অভিহিত হতাে। তারা বাবেলের (সিরিয়ার নিকটবর্তী স্থানের) অধিবাসী হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর পুত্র ইসমাইল (আ)-এর বংশধর ছিলেন। ইসমাইল (আ)-এর ৫৮ তম অধঃস্তন পুরুষ আল-ফিহরের অন্য নাম ছিল কুরাইশ। সে নাম হতেই কুরাইশ বংশ নামের উৎপত্তি ঘটে।


আরব দেশের অধিবাসী

আরব ভূখণ্ডের ভূপ্রকৃতির তারতম্যের কারণে সে দেশের অধিবাসীদেরকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা- (১) শহরের স্থায়ী বাসিন্দা ও (২) যাযাবর বা বেদুইন। এ দুই শ্রেণির আরববাসীর জীবিকা অর্জন ও জীবনযাত্রা প্রণালি, চাল-চলন, আচার-অনুষ্ঠান, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ধ্যান-ধারণা প্রভৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।

শহরের স্থায়ী বাসিন্দা (শহরবাসী): হাজরামাউত, ইয়েমেন ও ওমান নিয়ে গঠিত দক্ষিণ আরবের উর্বর
অঞ্চলগুলােতে প্রাচীন আরবের জনপদ গড়ে উঠেছিল। এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দারা কৃষিকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে কালাতিপাত করতাে। তারা অনেকটা সভ্য জীবন যাপন করতাে। এ সকল স্থায়ী বাসিন্দারা শহরবাসী নামেও অভিহিত হতাে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে বহির্বাণিজ্য ও সংযােগ স্থাপন করেছিল।

যাযাবর বা বেদুইন: ৮০% মরুবাসী আরব যাযাবর (আহল উল বাদিয়া) বা বেদুইন নামে আখ্যায়িত হতাে। তারা পরিবারবর্গ, উট, ভেড়া ও ঘােড়ার খাদ্যের সন্ধানে একস্থান হতে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াত। তাদের কোনাে প্রকার স্থায়ী ঘর-বাড়ি ছিল না। শিকার ও লুণ্ঠন ছিল তাদের পেশা। তাদের গৃহ ছিল তাঁবু; আহার্য ছিল উটের মাংস; পানীয় ছিল উট ও ছাগলের দুধ; আর জীবিকা ছিল লুটতরাজ। ইতিহাসে গােত্রপ্রীতি ও যুদ্ধপ্রীতির জন্য তারা ছিল বিখ্যাত। বেদুইন আরবদের জাতীয়তাবােধ ও স্বদেশানুরাগ বলতে গােত্রপ্রীতিই বুঝাত। গােত্র প্রথাই ছিল বেদুইন সমাজের মূল ভিত্তি। প্রতিটি তাঁবু একটি পরিবার; কয়েকটি পরিবারের সমন্বয়ে একটি হেই (hayy) নামক সংগঠন; এরূপ কয়েকটি হেই-এর সংমিশ্রণে একটি গোত্র (qawm, a clan) এবং কিছুসংখ্যক গােত্রের সমন্বয়ে একটি জাতি (qabilah) গঠিত হতাে। প্রতিটি গোত্র বয়স, জ্ঞান-বুদ্ধি, বীরত্ব ও সাহসের ভিত্তিতে একজন শেখ বা গােত্রপতি নির্বাচন করতাে। শেখ পারিবারিক প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত গােত্রীয় পরিষদের সাথে পরামর্শ করে গােত্রের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বেদুইন সমাজের ভিত্তি হচ্ছে গােত্রীয় সংগঠন। আর আসাবিয়াহ (কৌম চেতনা) হচ্ছে তাদের গােত্রের মূলমন্ত্র। 


আরব দেশ ও আরববাসীর বৈশিষ্ট্য

আরব দেশের বৈশিষ্ট্য: আরব উপদ্বীপ একটি বিশাল ও বিস্তৃত মালভূমি। এ উপদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত অন্যান্য অংশ বা অঞ্চল হতে অনেক উঁচু। এদেশের ভূখণ্ড পশ্চিম হতে পূর্বদিকে ক্রমনিম্ন ঢালু ভূমি দ্বারা গঠিত। মধ্য আরবে কিছুসংখ্যক পর্বতশৃঙ্গ পরিদৃষ্ট হয়। এগুলাে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪০০০ হতে ৬০০০ ফুট উঁচু। মরুময় এ আরব ভূখণ্ডের জলবায়ু সর্বত্র উষ্ণ। এদেশে নাব্য নয় এরুপ ইতস্তত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছুসংখ্যক নদ-নদী ও ওয়াদি রয়েছে। ভূমি অনুর্বর। কেবলমাত্র মরূদ্যান এবং উপকূল ভাগ অপেক্ষাকৃত উর্বর।

ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মিলনকেন্দ্রে অবস্থান করেও এদেশ
যেন সমগ্র বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন। আরব ভূখণ্ডের অংশ মরুময়। (উত্তর ভাগে নুফুদ মরুভূমি এবং নুফুদ হতে আরম্ভ করে দক্ষিণভাগ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মাইল/৯৬০ কিলােমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে আরবের বৃহত্তম মরুভূমি আল-দাহনা (আল রব-আল খালী)। এছাড়া এদেশের পশ্চিম দিকে রয়েছে আল হারবাহ্ নামক আর একটি ক্ষুদ্র মরুভূমি। কতিপয় পর্বতমালা, কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদ-নদী, সল্পসংখ্যক মরূদ্যান এবং এক বিশাল ও বিস্তৃত মরুভূমি বুকে নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে বিদ্যমান রয়েছে প্রাচীনকালের আরব উপদ্বীপ বা আরব দেশটি। এ দেশের ভৌগােলিক অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি গুরুত্বপূর্ণও বটে।

আরববাসীর বৈশিষ্ট্য : আরব ভূখন্ডের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের ফলে সমগ্র প্রাচীন আরবের জনসমষ্টির মাত্র এক পঞ্চমাংশ ছিল স্থায়ী বাসিন্দা (বা শহরবাসী)। তারা কৃষিকার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতাে। তারা অনেকটা সভ্য জীবন যাপন করতাে। অপরপক্ষে আরবের চার পঞ্চমাংশ জনগােষ্ঠী ছিল যাযাবর বা বেদুইন। প্রাচীন আরব দেশকে যাযাবর বা বেদুইনদের দেশ বলে অভিহিত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। বেদুইন আরববাসী শিকার, লুণ্ঠন ও যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতাে। উট, ভেড়া ও ঘোড়া ছিল তাদের সকল কর্মকাণ্ডের সহায়ক। খেজুর ছিল তাদের প্রধান খাদ্য ও খেজুর বৃক্ষ বাসস্থান নির্মাণের সম্বল। এগুলাে ব্যতীত বেদুইনদের অস্তিত্বই কল্পনা করা যেত না। প্রাচীন আরববাসীর বিশেষ করে বেদুইন সমাজের মূল ভিত্তি ছিল গােত্রপ্রীতি। 'আসাবিয়া' ছিল তাদের গােত্রের মুলমন্ত্র। গােত্রের সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলেও ভিন্ন গােত্রের লােকদের সাথে প্রবল শত্রুতা ও
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিদ্যমান ছিল। এর ফলে গােত্রে গােত্রে প্রায়শ দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ সংঘটিত হতাে। তারা যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত বাকতে এত বেশি অভ্যস্ত ছিল যে জনৈক লেখক বলেন, "শত্রুকে কিংবা শত্রুর প্রতিবেশীকে আক্রমণ করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তারা সয়ং সহােদর ভ্রাতাকে আক্রমণ করতে কু্ন্ঠিত হতাে না।

প্রখ্যাত রােমান ঐতিহাসিক গিবন বলেন, "জাহেলিয়া যুগে মহানবি (স)-এর আবির্ভাবের প্রাক্কালে ১৭০০ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। 

লুটতরাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জিঘাংসা, হত্যা, চরিত্রহীনতা, মদ্যপান, কন্যাসন্তান হত্যা, নারী অপহরণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধে লিপ্ত থাকলেও তাদের মধ্যেও কিছু মহত্ত্বের সুকুমার গুণাবলি বিদ্যমান ছিল। জন্মগতভাবে প্রতিটি আরববাসী ছিল পূর্ণ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। প্রত্যেক আরব নিজেকে অভিজাত বলে বিশ্বাস ও দাবি করতাে। প্রতি আরববাসী নিজেকে 'সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ' বলে গণ্য করতাে। তাদের মতে, আরবজাতি বিশ্বের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। রক্তের বিশুদ্ধতা, বাগ্মিতা, কবিতা, অশ্ব, তরবারি, বংশ মর্যাদা ইত্যাদি ছিল তাদের গর্বের বিষয়বস্তু। তারা কুলুজি চর্চাকে বৈজ্ঞানিক চর্চার মর্যাদা দান করে। আতিথেয়তা, স্বাধীনতা-প্রীতি, সাহস, মনােবল, সহিষ্ণুতা, পৌরুষ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, দানশীলতা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীন আরবের অধিবাসীদের আর একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তারা ছিল স্বভাব কবি এবং তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল শ্রুতিধর। কেবলমাত্র মুআল্লাকাত ব্যতীত তাদের রচিত অন্যান্য কাব্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। জমিল, লবিদ, ইমরুল কায়েস প্রমুখ রচিত মুআল্লাকাত আজও বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

আরববাসীদের মধ্যে আরও একটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। তা হচ্ছে দক্ষিণ আরবের বাসিন্দারা ইয়েমেনী
বা কাহতানী নামে অভিহিত হতাে। এরা শান্ত ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল। উত্তর আরবে বসবাসরত জনগণ মুদারীয় নামে পরিচিত ছিল। দক্ষিণ আরবে প্রাচীন সেমিটিক, সাবেয়ী ও হিমাইয়ারী ভাষা প্রচলিত ছিল। উত্তর আরবের অধিবাসীরা আরবি ভাষায় কথা বলতাে।

বৈচিত্র্যময় আরবের ভৌগােলিক অবস্থান ও পরিবেশ আরববাসীদেরকে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে গড়ে তুলেছিল।

ভৌগােলিক প্রভাব : অদ্ভুত ও বিচিত্র ভৌগােলিক পরিবেশ আরব উপদ্বীপের জনগণের দেহ, মন, চরিত্র ও সকল প্রকার কর্মকাণ্ডের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরব ভূখণ্ডের স্বল্পসংখ্যক এলাকাতে যে অতি নগণ্য সংখ্যক কৃষিজীবী স্থায়ীভাবে বসবাস করতাে তাদের মধ্যে জীবনস্পন্দন ও কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হতাে। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে দেশ-দেশান্তরে গমন করতাে। বাইরের জগতের সাথে যােগাযােগের ফলে তাদের জীবন ছিল পরিবর্তনশীল। এভাবে তারা নিজস্ব সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

কিন্তু অধিকাংশ আরব ভূখণ্ড মরুময়। এখানকার মরুভূমি প্রকৃতির রূদ্র লীলাস্থল। প্রতিকুল প্রকৃতির সাথে লড়াই করে জীবনধারণ করতে হয় বলে মরুদুলাল আরবগণ কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, ধৈর্যশীল, রুক্ষ, দুর্ধর্ষ, দুঃসাহসিক জাতিতে পরিণত হয়েছে। ভৌগােলিক প্রভাব ও পরিবেশের কারণে আরবের রৌদ্রদগ্ধ বালুকা, নিষ্করুণ ও উন্মাদ 'লু' হাওয়া', রুদ্র পর্বতমালা সে দেশের অধিবাসীদেরকে পরিশ্রমী ও সংগ্রামশীল জাতিরূপে গড়ে তুলেছে। নিজেদের আহার ও পানীয় এবং পশুচারণ ও পশুপালনের প্রয়ােজনে মরুবাসী বেদুইনগণ যাযাবর বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

নিরাপত্তার প্রয়ােজনে তারা স্ব-স্ব গােত্রের দলপতির নেতৃত্বে দলবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করতাে। আত্ম রক্ষার তাগিদেই তারা আক্রমণাত্মক ও আত্মরক্ষামূলক উভয় প্রকার যুদ্ধে পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল।

এরূপে গৃহীত সৈনিকবৃত্তি তাদের জীবনে শৃঙ্খলা, সংঘবদ্ধতা, একতা, শক্তি ও সাহস সঞ্চার করতে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবেই মরুবাসী আরব বেদুইনদের জীবনে আরাম-আয়েশ ছিল না। ছিল শুধু মুক্ত জীবনের অফুরন্ত আনন্দ ও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার অপূর্ব আকাঙ্ক্ষা। মাথার উপর সুবিশাল সুনীল আকাশ ও পদতলে সীমাহীন মরুভূমির স্বাধীন আবহাওয়ায় মানুষ হয়ে তারা স্বাধীনতাকেই জীবনের প্রধান সম্পদ বলে মনে করতাে।

ভৌগােলিক পরিবেশের কারণে খাদ্য ও পানীয়ের দুষ্প্রাপ্যতা, দুঃসহ তাপ, রাস্তাঘাটের অভাব বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে আরব দেশকে রক্ষা করেছে। আরববাসী কোনাে শক্তির কাছে মাথা নত করতে রাজি ছিল না। তারা প্রতিবেশী অন্যান্য জাতির ন্যায় মহাবীর আলেকজাণ্ডারের আনুগত্য স্বীকার করে নি কিংবা তার নিকট কোনো দূতও পাঠায়নি। দেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতির প্রভাবে আরবের প্রতিটি নাগরিক দেশের স্বাধীনতা অটুট রাখতে সচেতন ছিল। 

এভাবে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আরবের ভৌগােলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বৈচিত্র্য দেশ-বাসীর স্বভাব ও চরিত্র গঠনে এবং ইতিহাস রচনায় অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছিল। 

উপরােল্লিখিত ভৌগােলিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে ও প্রতিপালিত হয়ে মরুবাসী আরব সন্তানরা অন্য জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে তা আরও উন্নত ও সুমার্জিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা লাভ করেছিল। এ ক্ষমতা- বলে তারা মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রীকো-রােমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে তা পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের অনুপ্রেরণায় আরববাসীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তাই বলা হয়ে থাকে যে, “ইসলামের সফলতার মূলে ছিল বেদুইনদের লুপ্ত ক্ষমতা ও প্রতিভা। খলিফা ওমর (রা)-এর ভাষায়, বেদুইনরাই ইসলামকে চমৎকার মাল-মশলা সরবরাহ করেছিল।”


আরবের প্রাচীন রাজ্যসমূহ 

সাবিয়ান রাজ্য : সাবিয়ানগণ ইয়েমেনে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল মারিব। তাদের বর্ণমালা ছিল সিনিয়াটিক। তারা সাবিয়ান ও মিনাই - উভয় ভাষাতেই কথা বলতাে। তাদের বর্ণমালার সাথে মিশরীয় বর্ণমালার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন মিশরবাসী তাদের মন্দিরসমূহে ব্যবহারের জন্য সাবিয়ান রাজ্যে উৎপাদিত বিখ্যাত সুগন্ধি দ্রব্যসমূহ আমদানি করতাে। 

সাবিয়ানগণই ছিল আরব অধিবাসীদের মধ্যে প্রথম সভ্য জাতি তারা সুদক্ষ নাবিক ও বণিক হিসেবে খ্যাত ছিল। লােহিত সাগরের মধ্য দিয়ে তারা ‘বাব-আল-মান্দাব’ হয়ে মধ্য মিশরের ওয়াদি আল হাম্মামাত পর্যন্ত বাণিজ্যিক প্রয়ােজনে যাতায়াত করতাে। স্থলপথে ইয়েমেন হতে মক্কা, পেট্টা, সিরিয়া, মিশর এবং মেসােপটেমিয়ায় গমনাগমনের পথও তাদের জানা ছিল। বাইবেলে বর্ণিত শেবা নগরে তাদের ছিল আদি আবাসস্থল। সাবিয়ানগণ খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ হতে ১১৫ অব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

ঐতিহাসিক মারিব বাঁধ নির্মাণ ছিল সাবিয়ানদের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বলতম কৃতিত্ব। মারিব নগর সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৩৯০০ ফুট উঁচু স্থানে অবস্থিত। কারাে কারাে মতে, ৫৭০—৫৭১ খ্রিস্টাব্দে আবরাহার শাসনামলে (মতান্তরে মযায়ফিয়া নরপতির আমলে) এ বাঁধটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রথম যুগের সাবিয়ান শাসকদের উপাধি ছিল মুকাররিব। এ সময় সাবিয়ান শাসকগণ একাধারে ছিলেন রাজা ও পুরােহিত। দ্বিতীয় সাবিয়ান যুগের সূত্রপাত ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ থেকে। এ সময় সাবিয়ান নৃপতিগণ ‘মালকস্ববা’ উপাধি গ্রহণ করেন। তারা পৌরহিত্যের কার্যকলাপ থেকে নিজেদেরকে নিবৃত্ত রাখতেন। দ্বিতীয় সাবিয়ানগণই দক্ষিণ আরবের রাজবংশগুলাের মধ্যে ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী। সে যুগের শিলালিপি, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্প প্রভৃতি আজও দক্ষিণ আরব সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করছে। 

মিনাইয়ান রাজ্য : সাবিয়ানদের পাশাপাশি মিনাইয়ানগণও একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ রাজ্যটির অবস্থান ছিল নাজরান হাজরামাউতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এর স্থায়িত্বকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ হতে ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত। এ রাজ্যের রাজধানী কারনাওস (বর্তমান আরবি নাম মা’য়ীন বা ঝর্ণাধারা) ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে হ্যালেভি নামক জনৈক ঐতিহাসিক পরিদর্শন করেন। মিনাইয়ান রাজ্যের অধিবাসীদের ভাষা ও বর্ণমালা ছিল সাবিয়ানদের অনুরুপ। মুলার নামক জনৈক প্রত্নতত্ত্ববিদ শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে ২৬ জন মিনাইয়ান রাজার নাম আবিষ্কার করেছেন। কালক্রমে সাবিয়ানগণ মিনাইয়ানদেরকে পরাজিত করে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ আরবে তাদের রাজ্য ও আধিপত্য বিস্তার করেন।

কাতাবান ও হাজরামাউত রাজ্য : মিনাইয়ান ও সাবিয়ান রাজ্যদ্বয় ছাড়াও ঐ অঞ্চলে কাতাবান ও
হাজরামাউত নামক আরও দুটি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। কাতাবান রাজ্যটি বর্তমানের আদান শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত ছিল। কাতাবানের রাজধানী ছিল তামনা (বর্তমানে কুহলান)। এ রাজ্যটি খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ হতে ৫০ অব্দ পর্যন্ত বিরাজমান ছিল।

হাজরামাউত রাজ্যটি বর্তমানের হাজরামাউত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এর রাজধানী ছিল সাবওয়াহ। এ রাজ্যটির স্থিতিকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১ম খ্রিস্টীয় শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত।

এ রাজ্য দুটো মাঝে মাঝে মিনাইয়ান ও সাবিয়ান রাজদ্বয়ের কর্তৃত্বাধীনে চলে যেত। তবে রাজ্য দুটি মাল-
মসলার ব্যবসার জন্য এবং সুন্দর সুন্দর কারুকার্যখচিত দালানকোঠার জন্য সমসাময়িককালে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

হিমারীয় রাজ্য : সাবিয়ান এবং মিনাইয়াগণ হতে উদ্ভূত হিমারীয়গণ খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ অব্দ হতে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ আরবে রাজত্ব করেন। জাফর নামক স্থানে তারা রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। তাদের নির্মিত বিভিন্ন প্রকার বাঁধ, কূপ ও সেচ ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ হতে অনুমান করা হয় যে, হিমারীয় সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক। শহরবাসী হিমারীয়গণ যাযাবর বেদুইনদের আক্রমণ হতে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে গুমদান নামক স্থানে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করে তথায় ২০ তলাবিশিষ্ট একটি ইমারত তৈরি করেছিল। গুমদানের এই দুর্গটির উচ্চতা ছিল ৩০০ ফুট; ইতিহাসের প্রথম সর্বোচ্চ আকাশচুম্বী স্থাপত্যকর্ম। তাদের রাজ্যে প্রচলিত স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রায় একদিকে রাজার এবং অপর দিকে একটি ষাঁড় বা পেঁচার প্রতিকৃতি অঙ্কিত থাকতাে। হিমারীয়গণ হাজরামাউতসহ সমগ্র উপকূল ও লােহিত সাগরের তীরস্থ অঞ্চলসমূহ করতলগত করে। হিমারীয় নরপতিদের উপাধি ছিল 'তুব্বা।

আবিসিনিয়ানগণ হিমারীয় রাজ্যটি দখল করে ৩৪০ হতে ৩৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তথায় তাদের শাসন কায়েম রাখে। অতঃপর হিমারীয়গণ তাদের রাজ্য পুনরুদ্ধার করে দ্বিতীয় হিমারীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এ সময় ইয়েমেনে সর্বপ্রথম খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্ম বিস্তার লাভ করে। ফলে দক্ষিণ আরবের জনগণ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহের উপাসনা শুরু করে। আবিসিনিয়ানগণ পুনরায় হিমারীয় রাজ্যটি অধিকার করে (৫২৫-৫৭৫ খ্রি.)। এ সময় কুখ্যাত খ্রিস্টান রাজা আবরাহা নতুন রাজধানী সানাতে মক্কার পবিত্র কাবাগৃহের প্রতিদ্বন্দ্বীস্বরুপ একটি প্রসিদ্ধ গীর্জা নির্মাণ করেন। তিনি বিখ্যাত মারিব বাঁধ ধ্বংস করে মহানবির (স) জন্মের বছরে ৫৭০ (মতান্তরে ৫৭১) খ্রিস্টাব্দে একটি বিশাল হস্তীবাহিনীসহ কাবাগৃহের ধ্বংস সাধনে মক্কা অবরােধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঝড়, শিলাবৃষ্টি এবং এক জাতীয় ক্ষুদ্র পাখির আক্রমণে তার হস্তীবহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং স্বয়ং আবরাহা বিপর্যস্ত হয়ে পলায়ন করেন। এ আক্রমণের বর্ষকে "আমুল ফীল বা হস্তীবর্ষ" বলা হয়ে থাকে।

পারস্যের সম্রাট নওশেরওয়ানের সাহায্যে হিমারীয় বংশের জনৈক সায়িফ ইবনে যিইয়াযান নামক বীর
আবিসিনিয়ানদের ঘৃণিত শাসন হতে ইয়েমেনকে মুক্ত করেন। এর ফলে দক্ষিণ আরবে পারস্যের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার লাভ করতে থাকে। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, প্রাক-ইসলামি যুগে আরবে খ্রিস্টান, ইহুদি ও পারসিকদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আরব বেদুইনদের উপর কোনাে বিদেশি সভ্যতা কিংবা ধর্ম আদৌ রেখাপাত করতে সক্ষম হয়নি।

উত্তর এবং মধ্য আরবের রাষ্ট্রসমূহের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

প্রাক-ইসলামি আরবে দক্ষিণ আরবের বিভিন্ন রাজ্যের ন্যায় উত্তর এবং মধ্য আরবেও কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এ সকল রাজ্য ছিল সামরিক বৈশিষ্ট্য বিবর্জিত। প্রধানত এবং মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তিতেই এগুলাের অভ্যুত্থান ঘটে।

নাবাতিয়ান রাজ্য : উত্তর আরবের রাজ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নাবাতিয়ান রাজ্য। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল পেট্টা। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যাযাবর নাবাতিয়ানগণ ট্রান্স জর্ডান হতে উত্তর আরবে আগমন করে ইডােমাইটদের পরাজিত করে তাদের রাজ্য অধিকার করে। এ রাজ্যের রাজধানী পেট্টা ভূমধ্যসাগর হতে দক্ষিণ আরবের সবা পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল। ফলে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পেট্টার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। খ্রিস্টের জন্মের সময় এ রাজ্য দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এ রাজ্যের জনগণ আরবি ভাষায় কথা বললেও তাদের সাহিত্যে এ্যারামাইক লিপির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তাদের বক্র হস্তলিপি তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে পবিত্র কুরআন মজিদের ভাষার রূপ পরিগ্রহ করে। খ্রিস্টের আবির্ভাবকালে নাবাতিয়ান সভ্যতার চরম উৎকর্ষ ও বিকাশ সাধিত হয়। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যটি রােমানদের করতলগত হয়। ১০৬ খ্রিস্টাব্দে এটি একটি রোমান প্রদেশে পরিণত হয়। রােমান শাসনামলে পেট্টা সমসাময়িককালের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী নগরীতে পরিণত হয়েছিল।

পালমিরা রাজ্য : পালমিরা রাজ্যটি বিবাদমান পার্থিয়ান ইরানীয়ান ও রােমান সাম্রাজ্যের মধ্যস্থলে বিদ্যমান থেকে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে স্বীয় নিরাপত্তা ও স্বধীনতা বজায় রাখতে তৎপর ছিল। এ রাজ্যের ভৌগােলিক অবস্থান, প্রচুর টাটকা ও খনিজ পানির সরবরাহ করার ক্ষমতা পালমিরাকে পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্য পথের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল।

আরবদের নিকট পালমিরা রাজ্যটি 'তাদমুর' নামে অভিহিত হতাে। আরবগণ কর্তৃক কখন এ রাজ্যটি অধিকৃত হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস বলা দরূহ ব্যাপার বটে। তবে ১৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে ২৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ঘনবসতিপূর্ণ এ প্রাচীন রাজ্যটি উন্নতির চরম শিখরে আরােহণ করেছিল। ঐতিহাসিক হিট্টির ভাষায়, "খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে এ রাজ্যের মরুভূমিতে বিদ্যমান রাজধানীটি নিকট-প্রাচ্যের অন্যতম সম্পদশালী শহরে পরিণত হয়েছিল"। 

খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে এ রাজ্যটি রােমানদের করতলগত হয়। তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে পালমিরা রাজ্য রােমান সম্রাটের প্রতি নামেমাত্র আনুগত্য প্রদর্শন করে শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভ করে। পালমিরার উজায়নাহ নামক পরাক্রমশালী শাসক পার্থিয়ানরাজ প্রথম শাহপুরের আক্রমণ প্রতিহত করেন। তিনি উত্তর আরব, সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, মিশর, আর্মেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে পালমিরা রাজ্যের অধিপতি সমগ্র পশ্চিম এশিয়ার উপর আধিপত্য বিস্তার করলে তাঁকে এবং তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে হিমস-এ (সম্ভবত রামান সম্রাটের দ্বারা) বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় অবলম্বন করে হত্যা করা হয়। তাঁর (উজায়নাহ) সুযোগ্য স্ত্রী জেনােবিয়া সিংহাসনে আরােহণ করে রােম-অধিকৃত আলেকজান্দ্রিয়া দখল করেন। তাঁর স্ত্রী জেনােবিয়ার বীরত্বে শঙ্কিত হয়ে ২৭২ খ্রিস্টাব্দে রােমান সম্রাট অরেলিয়ান তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে পালমিরা রাজ্যের অস্তিত্বের বিলােপ সাধন করেন।

জাতিতে আরব হলেও আরামাইক ভাষায় কথা বলতে পালমিরানগণ অভ্যস্ত ছিল। তারা সৌরজগতের উপাসনা করতাে। গ্রিক, সিরিয়ান ও পার্থিয়ান সভ্যতার সংমিশ্রণে পালমিরান সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল।

ঘাসসানি রাজ্য : মারিব বাঁধ ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে দক্ষিণ আরবের একটি গােত্র আমর মুযায়কিয়ার নেতৃত্বে উত্তর আরবে গমন করে। মুযায়কিয়ার পুত্র যাফনাহ ইবনে আমর দামেশকের দক্ষিণ-পূর্বে খাসসানি রাজ্যের পত্তন করেন। এ রাজ্যটি হাওরান, বালকা, ফনিসিয়া, লিবানাম, প্যালেস্টাইন, প্রেমা এবং সিকুণ্ডা জেলার সমন্বয়ে গঠিত ছিল। খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে ঘাসসানি রাজ্যে রােমানদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে। রােমান সম্রাটের সাহায্যে ঘাসসানি রাজ্য আরব বেদুইনদের অগ্রগতি রােধ করার জন্য একটি নিরপেক্ষ রাজ্যে (Buffer state) পরিণত হয়।

ঘাসসানি রাজবংশে ষষ্ঠ শতাব্দীতে কয়েকজন শক্তিশালী শাসকের আবির্ভাব ঘটে। এ সকল শাসকের মধ্যে আল-হারিস এবং তৎপুত্র আল-মুনজীরের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঘাসসানি বংশের শেষ নরপতি ছিলেন জাবালা-বিন আল-আইহাম। ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধে রােমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুসলমানেরা যুদ্ধে জয়লাভ করলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ঘটনাচক্রে খলিফা ওমরের বিচারে তাকে শাস্তি প্রদান করা হলে তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। ৬১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে সাসানীয় বংশের শাসক খসরু পারভেজ জেরুজালেম ও দামেস্ক অধিকার করলে ঘাসসানি রাজবংশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

মুয়াল্লাকা কবি লােবিদ, নাবিনা এবং মহানবির (স) সমসাময়িক কবি হাসান বিন সাবিত ঘাসসানি বংশের
কবি ছিলেন। ঘাসসানি শাসকদের দরবার জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। তাদের দরবারে ব্যাবিলনীয়, গ্রিক এবং বিভিন্ন দেশের গায়ক-গায়িকা ও বাদ্যকারের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ঘাসসানি আমলের সভ্যতা আরব, সিরিয়ান ও গ্রিক সভ্যতার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল।

লাখমিদ বংশ : খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে ইয়েমেনের তানুখ গােত্র আরবের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অর্থাৎ দজলা-ফোরাত (টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস) উপত্যকায় আগমন করে প্রথমে তাবুতে বসবাস করা শুরু করে। পরবর্তীকালে প্রাচীন ব্যাবিলনের সন্নিকটে কুফার ৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত আলহিরায় স্থায়ীভাবে তারা বসতি স্থাপন করে। অতঃপর লাখমিদ বংশীয় বীর আমর-বিন-আদী এখানে একটি সমৃদ্ধিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল হিরা। লাখমিদ বংশীয় নরপতিগণ এখানে সপ্তম শতকের শেষভাগ পর্যন্ত তাদের আধিপত্য অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হন। লাখমিদদের প্রতিষ্ঠিত হিরারাজ্যে পারসিকদের প্রভাব বিদ্যমান ছিল।

লাখমিদ বংশে সর্বমােট ২০ জন নরপতি ছিলেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। নরপতিগণের মধ্যে ইমরুল কায়েসের (৩২৮ খ্রি.) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোেগ্য। তাঁরই পুত্র নুমান পারস্য সম্রাট বাহরাম গােরের জন্য বিখ্যাত আল-খাওয়ারনাক নামক একটি অপূর্বসুন্দর দুর্গ ও রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। আমর-বিন হিন্দ [৫৫৪-৫৬৯ খ্রি.] নামক জনৈক নরপতি স্বয়ং একজন কাব্যরসিক ব্যক্তি ছিলেন। বিখ্যাত ময়াল্লাকা কবি তারাকা-বিন আবদ, হারিছ-বিন-হিল্লীযা এবং আমর-বিন-কুলছুম তাঁর রাজ দরবার অলংকৃত করেন। আমরের মাতা হিন্দ খ্রিস্টান ছিলেন বলে লাখমিদদের রাজ্যে সহজেই খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তিত হয়। লাখমিদ বংশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে তৃতীয় নুমান-আবু-কাবুসের আমলে (৫৮০-৬০২ খ্রি.)। লাখমিদগণ আরবি ভাষায় কথা বললেও তাদের শিক্ষার বাহন ছিল সিরিয়াক ভাষা। এ বংশের, রাজত্বকালে আরব উপদ্বীপে পারসিয়ান সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে।

কিন্দা রাজ্য : দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন অঞ্চল হতে আগমন করে কিন্দা গােত্র মধ্য আরবে একটি রাজ্য
স্থাপন করেন। পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি এ বংশের উদ্ভব ঘটে। দক্ষিণ আরবের শেষ তুববাদের সাথে এদের সম্পর্ক ছিল। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা হুযর (উপাধি আকিল আর মুরার) ছিলেন হিমারীয় হাসান ইবনে-তুব্বার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। হুযুর মালিক (রাজা) উপাধি ধারণ করেন। তাঁর উত্তরাধিকারী ছিলেন মালিক আমর।

এ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক এবং আমরের উত্তরাধিকারী আল-হারিস পারস্য সম্রাট কুবাদের মৃত্যুর কিছুকালের জন্য আল-হিরা অধিকার করেন (৫২৯ খ্রি.)। তিনি লাখমিদ শাসক তৃতীয় আল-মুন্দির কর্তৃক নিহত হন। আল-হারিস বাগদাদের ৪০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত আনবার শহরে বসবাস করতেন। সর্বশেষ্ঠ মুয়াল্লাকা কবি ইমরুল কায়িস কিন্দা রাজ্যের সর্বশেষ রাজপুত্র ছিলেন। পরবর্তীকালে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ক্ষমতা অধিকারের দ্বন্দ্ব ও গৃহবিবাদ দেখা দিলে কিন্দার সংহতি বিনষ্ট হয় এবং কালক্রমে সেটি হিরা রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়।

ইমরুল কায়েস পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য লাভের আশায় কনস্টান্টিনােপলে সম্রাট কনসটেনটাইনের নিকট গমন করেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনকালে আংকারার সন্নিকটে বিষ প্রয়ােগে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে হত্যা করা হয়।

এ রাজ্যের গুরুত্ব এ কারণেই যে, তারাই (কিন্দাগণ) সর্বপ্রথম মধ্য আরবে গােত্রবিভক্ত আরবদেরকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে একটি রাজ্য স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। 


তথ্যসূত্র : 
বই : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : হাসান আলী চৌধুরী।

নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার মতামত লিখুন :