ইতিহাসে নীল কন্যা বা "The daughter of the Nile" নামে খ্যাত মিশরের প্রাচীন ইতিহাস বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে একটি গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় সংযােজন করেছে। প্রাচীন মিশরই ছিল বিশ্বের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অগ্রদূত। ঐতিহাসিকদের মতে মিশরীয় সভ্যতা ছিল ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ফিনিসীয়, হিব্রু, মহেঞ্জোদাড়াে ও হরপ্পার সভ্যতা অপেক্ষাও অধিক প্রাচীন। এ সকল সভ্যতা মিশরীয় সভ্যতার কাছে ছিল ঋণী। প্রফেসর ফ্লিন্ডার্স পেট্টি মিশরীয় সভ্যতাকে খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ বছরের প্রাচীন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ঐতিহাসিক মায়ার্স (Myers) যথার্থভাবেই বলেন, “এরূপে আমরা লক্ষ করি যে, সভ্যতার ক্ষেত্রে মিশর মূল্যবান অবদান রেখেছে। নীলনদের সভ্যতার উপাদানসমূহ অধিকহারে পরবর্তীকালে পশ্চিম এশিয়া, গ্রিক এবং রােমান সভ্যতায় পরিলক্ষিত হয়। এগুলাের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।”
নীলনদের দান মিশর
মিশরকে “নীলনদের দান" (The Gift of the Nile) বলা হয়। কারণ নীলনদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতাে। প্রতি বছর জুন হতে অক্টোবর মাসের মধ্যে নীলনদের উভয় তীর প্লাবিত হয়। প্লাবন শেষে পলিমাটিতে উভয় তীর দৈর্ঘ্যে ৬০০ মাইল এবং প্রস্থে ১০ মাইল পর্যন্ত ভরে যায়। এরূপে সঞ্চিত পলিমাটির গুণে উভয় ভূ-ভাগ অত্যন্ত উর্বর হয়। ফলে প্রচুর শস্য, তুলা প্রভৃতি উৎপন্ন হওয়ায় মিশর একটি সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকা এ তিনটি মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকায় এবং ভূমধ্যসাগরের উপকূলে বিদ্যমান হবার ফলে মিশরের ভৌগােলিক অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নীলনদের তীরে সিনাই পাহাড় ও অন্যান্য পর্বতমালা এবং চুনা পাথরের পাহাড়গুলাে মিশরবাসীকে শিল্পদ্রব্য ও অত্র-শস্ত্র তৈরি করার জন্য বিভিন্ন প্রকার ধাতু সরবরাহ করেছে। মিশরের সমৃদ্ধি, আড়ঘর ও প্রগতি এ সকল দ্রব্যসামগ্রী এবং উল্লেখিত সুযােগ-সুবিধার জন্য সম্ভব হয়েছে। এক কথায়, গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও নীলনদের দানের ফলে মিশরেই বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে।
মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের পূর্বের মিশরীয় ইতিহাসকে প্রাক-ডাইনেস্টি যুগ বলা হয়। এ যুগে মিশরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এ সময় মিশরে বসবাসকারী জনগণ ককেশাস জাতির ভূমধ্যসাগরীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত বলে ধারণা করা হয়। নিগ্রো ও সেমেটিক জাতির সংমিশ্রণও তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তারা সেমিটিক ভাষায় কথাবার্তা বলত। তারা ছিল খাটো, কৃষ্ণকায়, লম্বা নাক, কালাে চুল এবং লম্বা মাথাবিশিষ্ট জাতি।
প্রাক-ডাইনেস্টি যুগাবসানের পর মিশর উত্তর মিশর ও দক্ষিণ মিশর এ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এ দুই অংশকে একত্রিত করে মেনেস তার শাসক নিযুক্ত হন এবং তার রাজধানী স্থাপিত হয় মেশফিস শহরে। পরবর্তীকালে রাজধানী থিবেস শহরে স্থানান্তরিত হয়। প্রাচীন মিশরে ৩১টি রাজবংশ প্রায় ৩০০০ হাজার বছরকাল ধরে রাজত্ব করেন।
খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে প্রাচীন রাজবংশের পরিসমাপ্তি ঘটলে সামন্ত যুগের সূচনা হয়। মিশরের ইতিহাসে এ যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-২১০০ অব্দ) অনাচার, ব্যভিচার, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার যুগ হিসেবে কলঙ্কিত হয়ে রয়েছে। এর মূলে ছিল সামন্তরাজদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কোন্দল।
খ্রিস্টপূর্ব ২১০০–১৭৮৮ অব্দ পর্যন্ত মিশরে রাজবংশের পুনরাবির্ভাব ঘটে। এ সময় মিশরের জনগণ রাজকার্যে অংশগ্রহণের সুযােগ লাভ করে। জনগণ ভূ-সম্পত্তির মালিকানাপ্রাপ্ত হয়। এ যুগের সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে আখ্যায়িত করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দে দক্ষিণ এশিয়ার যাযাবর জাতি যারা ইতিহাসে হিকসস নামে পরিচিত তারা আক্রমণ পরিচালনা করে মিশরীয় রাজতন্ত্রে কুঠারাঘাত করে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ১৫৮০ অব্দে মিশরীয়গণ সংঘবদ্ধভাবে এক অভিযান পরিচালনা করে হিকসসদেরকে মিশর থেকে বিতাড়িত করে। অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭৯ অব্দে মিশরীয়গণ সিরিয়া ও ইরাক অধিকার করে। এ সময় ফনেসীয়, ক্যালদীয় , হিটাইট ও অ্যাসিরীয়গণও তাদের পদানত হয়।
মিশরের পতন
মিশরের নৃপতিগণ তাদের সুহৃদ ও অমাত্যগণকে বিপুল ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। ফলে তারা উচ্চাভিলাষী ও পরাক্রমশালী হয়ে পড়ে। তারা প্রত্যেকেই রাজা হবার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ গােলযােগের সূত্রপাত ঘটে এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য হ্রাস পেতে থাকে। এভাবে ষড়বিংশতি রাজবংশের শাসনকালের শেষের দিকে মিশরীয় সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রথমদিকে ব্যাবিলন এবং পরের দিকে পারস্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে মেসিডােনিয়ান , রােমান, আরব, তুর্কি ও ইংরেজদের কবলে মিশর চলে যায়। অতঃপর বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালনার ফলে সুয়েজ খাল থেকে ইংরেজ সৈন্য অপসারিত হলে কর্ণেল নাসেরের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে মিশর পরিপূর্ণভাবে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে।
প্রাচীন মিশরের শাসনব্যবস্থা
প্রাচীন মিশরীয় শাসনব্যবস্থায় পুরােহিততন্ত্রের প্রভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। একচ্ছত্র অধিপতি মিশরের রাজা নিজেকে সূর্য দেবতা “রা'-এর সন্তান বলে দাবি করতেন এবং তিনি তার (অর্থাৎ ঈশ্বরের) প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য শাসন করতেন। মিশরের রাজাদের উপাধি ছিল ফ্যারাও বা ফেরাউন। ফেরাউন কথাটির উৎপত্তি হয়েছে “পের-অ” [ অর্থাৎ বৃহৎ গৃহ অথবা রাজ-পরিবার | হতে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা এবং প্রাচীন আইন মােতাবেক ফেরাউন রাজ্য শাসন করতেন।
মিশরের পিরামিড
খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দে খুফু নামক জনৈক রাজা বর্তমান কায়রাে নগরী হতে দক্ষিণ-পশ্চিমে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত মরুভূমিতে ১৩ একর জমির উপর ১০০০০০ (এক লক্ষ) কারিগর ও শ্রমিকের সাহায্যে ২০ বছর ধরে পাথরের বিশাল পিরামিড নির্মাণ করেন। এটা লম্বায় ৭৫৫ ফুট এবং উচ্চতায় ৪৮১ ফুট। এর নির্মাণে ২৩ লক্ষ পাথরের বড় বড় টুকরা ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি পাথরের ওজন আড়াই টন এবং নির্মিত পিরামিডটির ওজন ৩৮, ৮৩,০০০ টন। গিজার বিখ্যাত পিরামিড মানুষের ইতিহাসের একটি স্বাক্ষর হিসেবে দণ্ডায়মান রয়েছে। জড় শক্তির উপর একটি মানুষের সার্বভৌম ক্ষমতার বিজয়কে সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করে। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হবার পূর্বে মিশরের কারিগরি উদ্ভাবনী কৌশলের সাথে তুলনায় আমরা আদৌ শ্রেষ্ঠ ছিলাম না।
মিশরীয়দের ধর্মীয় ইতিহাস
প্রাচীন মিশরীয়দের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মের প্রভাব ছিল অপরিসীম। শুধু ধর্মীয় শাসন বা পুরােহিততন্ত্রেই নয়; অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও ধর্মের অনুশাসনের প্রতিফলন পরিদৃষ্ট হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন জাতিগুলাের মধ্যে মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন করে। মিশরীয়দের প্রধান দেবতার নাম ছিল ‘আমন-রে’। নীলনদের দেবতার নাম ছিল ওসিরিস। বিড়াল, কুমীর, ধাঁড়, নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক পক্ষীও তাদের শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। তাদের ধর্মীয় জীবনে ‘বা’ (আত্মা) এবং ‘কা’ (কায়া)-এর প্রভাব ছিল সর্বাধিক। মৃত্যুর পর ‘বা’ পুনরায় তারই ‘কা’তে আশ্রয় গ্রহণ করত। এভাবে তারা আত্মার অবিনশ্বরতা ও পরজন্মে বিশ্বাসী ছিল। দেহ ছাড়া আত্মা ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভে বঞ্চিত হতে পারে, এ কারণে তারা দেহকে সংরক্ষণ করার জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে সুগন্ধ দ্রব্য ও রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা মমি প্রস্তুত করত। মমিকে যুগ পরম্পরায় অক্ষত রাখার জন্য নির্মিত হয় সমাধি স্তম্ভ পিরামিড। পুনর্জন্মে গভীর বিশ্বাসের জন্য তারা মৃতদেহের সাথে নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য কবরের পাশে রেখে দিত। তারা আরও বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পর অসিরিস নামক বিচারকের সম্মুখীন হয়ে জীবনের হিসাব নিকাশ দিতে হবে। যারা সৎ ও ধর্মভীরু তাদের পুরস্কারস্বরূপ ‘স্বর্গে' এবং পাপীদের ‘নরকে পাঠানাে হবে।
অতঃপর পুরােহিততন্ত্র চরম স্বৈরতন্ত্রের রূপ গ্রহণ করলে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭৫ অব্দে সম্রাট চতুর্থ আমেনহােটেপ পুরােহিতদের মন্দির থেকে বিতাড়িত করে দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। তিনি ইখনাটন নাম ধারণ করে 'এটন' বা একেশ্বরবাদের মতবাদ প্রচার করেন। এভাবে প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে একেশ্বরবাদের মূলমন্ত্রের প্রথম প্রতিষ্ঠাতার গৌরব অর্জন করেছিলেন সর্বপ্রথম তিনি। পরবর্তীকালে প্রায় ৬০০ বছর পর ইহুদিরা এ মতবাদ পুনরুজ্জীবিত করে।
মিসরীয়দের লিখন পদ্ধতি
বিশ্ব সভ্যতায় মিসরীয়দের অবদান প্রায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। মনের ভাব প্রকাশের প্রয়ােজনে সম্ভবত তারাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এই পদ্ধতিতে ২৪টি চিহ্ন ছিল এবং প্রত্যেকটি চিহ্ন বিশেষ বিশেষ অর্থ প্রকাশ করতাে। প্রাচীন মিশরীয়রা ছবির সাহায্যে লেখার কাজ পরিচালনা করতাে। ছবিগুলাে এমনভাবে আঁকা হতাে যাতে মনের ভাব ঠিকভাবে প্রকাশিত হয়। কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে মিশরে তিন ধরনের লিখন পদ্ধতির নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়; যথা- চিত্র লিখন, হিরাটিক (বা দ্রুত লিখন পদ্ধতি) এবং ডেমােটিক যা জনসাধারণ ব্যবহার করতাে। ঐতিহাসিক মায়ার্স বলেন, “সম্ভবত প্রাচীন মিশরীয়দের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে একপ্রকার লিখন পদ্ধতির প্রচলন। যিশু খ্রিস্টের জন্মের হাজার বছরের অধিক পূর্বে তারা আংশিকভাবে ছবির সাহায্যে এবং আংশিকভাবে অক্ষরের সাহায্যে এক প্রকার কৌতূহল উদ্দীপক ও জটিল লিখন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিল।”
তারা “পেপিরাস” নামক একপ্রকার ঘাস হতে কাগজ প্রস্তুত করত এবং শাক-সবজির রস দ্বারা কালি প্রস্তুত করে তীক্ষ্ণ শলাকাকে কলমরূপে ব্যবহার করতাে। উল্লেখ্য যে, মিশরীয়রা ডান হতে বাম দিকে লিখতাে।
মিসরীয়দের শিল্পচর্চা
মিশরীয়রা স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানত। এগুলাের সাহায্যে তারা নানাপ্রকার অলংকার আসবাবপত্র নির্মাণ করতাে। অস্ত্র-শস্ত্র তৈরিতেও তারা ছিল অত্যন্ত পারদর্শী। সুতি, পশমী, এমন কি নানা প্রকার কারুকার্যখচিত বস্ত্র বয়নেও তাদের দক্ষতা ছিল। মিশরীয় শিল্পকলা ইহুদি, গ্রিক ও ইউরােপীয় জাতিগুলােকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করেছে। তারা হিসাবপত্রে, ধাতবপাত্র ও দ্রব্যাদি নির্মাণে, বস্ত্র বয়নে, মৃৎপাত্র নির্মাণে এবং মিশরে নীলনদের জলাভূমিতে উৎপন্ন প্যাপিরাস নামক উদ্ভিদ হতে কাগজ, প্যান্ডেল, দড়ি প্রভৃতি নির্মাণ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দক্ষতা অর্জন করেছিল এবং বিশ্বের অন্যান্য জাতির উপর এগুলাের প্রভাব যথেষ্ট পরিদৃষ্ট হয়।
মিসরীয়দের সাহিত্যচর্চা
প্রাচীন মিশরীয়গণ সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করে গেছে। তাদের সাহিত্যচর্চা মূলত ছিল দর্শন ও ধর্মভিত্তিক। “পিরামিড টেকস্টস”, “মেমফিস ড্রামা”, “রয়াল সান হিম,” “মৃতদের পুস্তক", “আতেনের হিম” (ধর্ম সঙ্গীত) প্রভৃতি ছাড়াও তারা ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যেরও চর্চা করতাে। কাব্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে “পয়েমস্ অব পেনতুর” এবং প্রবচন সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রিসেপ্ট অব টাজ্জটেপ’-এর নাম সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। এভাবে তারা কাব্য, ছােটগল্প এবং ইতিহাস চর্চায় প্রভূত উন্নতি সাধন করে।
দর্শন শাস্ত্রে মিসরীয়দের অবদান
প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে যুক্তি ও মুক্ত বুদ্ধি বৃত্তির চর্চা ছিল। তাদের সকল চিন্তা-চেতনা শুধু ধর্মের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল না। মিশরীয় দার্শনিক ও মুনি-ঋষিগণ অনন্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে বিশ্বাস করতেন। নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে রচিত ‘ফাহোটেপের ম্যাক্সিম'-এ তাদের গভীর দার্শনিক তত্ত্বের পরিচয় মেলে।
মিসরীয়দের বিজ্ঞান চর্চা
বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় প্রাচীন মিশরীয়দের অশেষ অবদান লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায় তারা অসামান্য অবদান রেখেছে। তারাই সর্বপ্রথম জ্যামিতি ও অঙ্কশাস্ত্রের উদ্ভাবন করে। তারা যােগ, বিয়ােগ , ভাগ ও দশমিক প্রথার প্রবর্তন করে। জ্যামিতি শাস্ত্রে তারাই প্রথম কৌণিক, আয়তক্ষেত্র এবং ষড়ভুজ আবিষ্কার করে।
তারা জ্যোতির্বিদ্যায়ও প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল। মিশরীয়রা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতির পরিভ্রমণ এবং ঋতুর ক্রমবিকাশের সাথে নীলনদের বন্যার সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য সৌরবর্ষের আবিষ্কার করেন। তারা সৌর বছরকে ৩৬৫ দিনে বা ১২ মাসে এবং মাসকে ৩০ দিনে বিভক্ত করে। তাদের দিনপঞ্জি গ্রেগরিয়ান, সিজারিয়ান এবং জালালী দিনপঞ্জির জন্মদাতা বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। দন্ত চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, পাকস্থলীর পীড়ার চিকিৎসা, হৃদয় ও নাড়ীর জ্ঞানও তারা রাখতাে। এ সকল বিদ্যার জ্ঞান গ্রিকগণ ইউরােপে বহন করে।
স্থাপত্য ও নির্মাণ কৌশলে অবদান
প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত তাদের নির্মিত পিরামিডগুলাে এবং অদ্ভুত আকৃতির স্ফিংকস (Sphinx) আজও দর্শকদের বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে। মিশরের অক্ষত, মমীগুলােও আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীদের প্রতি একটি বিস্ময়কর চ্যালেঞ্জস্বরূপ।
স্থাপত্য শিল্পের কলাকৌশল হিসেবে স্তম্ভবেষ্টিত প্রাসাদ, বহুতলাবিশিষ্ট অট্টালিকা সবকিছুই মিশরে বিকাশ লাভ করে। তাদের স্থাপত্য শিল্পের কলাকৌশল গ্রিক ও রােমান স্থাপত্য শিল্প এবং মধ্যযুগীয় ইউরােপীয় স্থাপত্য শিল্পকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করে। স্থাপত্য নির্মাণ কৌশলের অনেক ক্ষেত্রেই প্রাচীন মিশরীয়দেরকে কেউই অতিক্রম করতে পারে নি। এখানে উল্লেখ্য যে শিল্পকলার ক্ষেত্রে সমসাময়িক সভ্যতাগুলাের উপর মিশর তার প্রভাব বিস্তার করেছিল। চিত্রকলায়ও প্রাচীন মিশরীয়দের পারদর্শিতা লক্ষণীয়। বিভিন্ন চিত্রকর্মে তাদের সমাজজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের মন্দির গাত্রে বহু Fresco বা দেয়ালচিত্র পরিলক্ষিত হয়।
মিশরীয়দের সমাজ ব্যবস্থা
মিশরীয় সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন রাজা, দ্বিতীয় শ্রেণিতে অমাত্যবর্গ, তৎপর পুরােহিতদের স্থান ছিল। উকিল, ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও লেখক মধ্যবিত্ত বা তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কৃষক ও শিল্পীরা ছিল চতুর্থ শ্রেণির অন্তর্গত। পঞ্চম ও সর্বনিম্ন শ্রেণির অন্তর্গত ছিল দাসরা। বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের মধ্যে তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল বলে অনুমিত হয় না।
জনৈক জনদরদী মিশরীয় নরপতি নীলনদের পূর্বাঞ্চল হতে লােহিত সাগর পর্যন্ত একটি খাল খনন করেছিলেন। এ খালটিকে সুয়েজ খালের অগ্রদূত বলা যেতে পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সে যুগে তামা ও সােনার আংটি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতাে।
মিশরীয় সভ্যতার মূল্যায়ন ও প্রভাব
এভাবে মিশরীয়গণ আধুনিক সভ্যতার মূলভিত্তি রচনা করে বিশ্ব সভ্যতার বিকাশে উল্লেখযােগ্য অবদান রেখে গেছে। ঐতিহাসিক রালফ এবং বার্ণ বলেন, “বর্তমান যুগের গুরুত্ব বিচারে প্রাচীনকালের খুব কম সভ্যতাই মিশরীয়দের অতিক্রম করতে পেরেছে।”,প্রফেসর সেইস বলেন, “আমরা প্রাচীন সভ্যতার নিকট ঋণী এবং উক্ত প্রাচীন সভ্যতার অধিকাংশই ছিল মিশরীয়দের সৃষ্টি। প্রাচীন মিশরীয়দের সরকার পদ্ধতি, আইন, স্থাপত্য, শিল্পকলা, সাহিত্য, ধর্ম, কৃষি, শিল্প, লিখন পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক বর্ষপঞ্জিকা ইত্যাদির নিকট বিশ্বসভ্যতা তথা পরবর্তীকালের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সকল সভ্যতা ঋণী। হিব্রু জাতি, ফিনিসীয় জাতি এবং গ্রিক জাতি সভ্যতার ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরীয়দের ছাত্র এবং তারা সবাই মিশরীয় সভ্যতা ধার করেছিল।
তথ্যসূত্র :
বই : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : হাসান আলী চৌধুরী।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন