শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস - History of the Industrial Revolution

শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস - History of the Industrial Revolution - বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet

শিল্প বিপ্লব এর সংজ্ঞা

যেসব প্রচেষ্টা ও পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে শিল্প যুগের সূচনা হয় তাদের সমষ্টিকেই শিল্প বিপ্লব বলে। 

শিল্প বিপ্লব মূলত 'শিল্প এবং 'বিপ্লব' দু'টি পৃথক শব্দের সমষ্টি। এর সমন্বিত অর্থ হলাে শিল্প সংক্লান্ত বিপ্লব। অর্থাৎ কায়িক শ্ৰমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তে যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন পদ্ধতির আবির্ভাব।


শিল্প বিপ্লব ধারণার নামকরণ 

উনবিংশ শতাব্দীর বিশ দশকে ফরাসি লেখকরা শিল্প বিপ্লব শব্দটিকে ব্যবহার করেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনন্ড জে টয়েনবি (Arnold Joseph Toynbee) তাঁর 'Lectures on the Industrial Revolution of the 18th Century in England' -এ শিল্প বিপ্লবের ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।


শিল্প বিপ্লব এর সূচনা

শিল্প বিপ্লব এর সময়কাল আঠার শতক এর মধ্যভাগে।
শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় ইংল্যান্ডে যা পরবর্তীতে সারা বিশ্বে দ্রু ছড়িয়ে পড়ে। তাই এটিকে কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা যায় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ড এবং পরে অন্যান্য দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে, তার প্রভাবে একটি গােটা যুগের অবসান হয়ে অন্য একটি নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটে।


শিল্প বিপ্লব এর কারণ

আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরােপে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এ বিপ্লবের পেছনে বেশ কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক কারণ ছিল। সামাজিক কারণগুলাে মূলত এই বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছিল। অন্যদিকে অন্যকারণগুলাে প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করেছিল বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে। নিচে কারণগুলাে আলােচনা করা হলো-

১.মূলধনের প্রসার 
শিল্প স্থাপনের জন্যে মূলধনের প্রয়ােজন হয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে বণিক পুঁজির বিকাশ লাভ করে। এ ছাড়া উন্নত প্রথায় কৃষি খামার পরিচালিত হওয়ায় এক শ্রেণীর ভূ-স্বামী অর্থশালী হয়। একই সংগে উন্নতর অর্থনৈতিক সংগঠনের (যেমন ব্যাংক ও স্টক এক্সচেঞ্জ) উদ্ভব জনগণের সঞ্চয়কে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিনিয়ােগে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি মুনাফার হার বৃদ্ধির ফলে উঠতি শিল্পপতিদের হাতে নতুন ভাবে বিনিয়ােগ যােগ্য অর্থের সমাগম হয়। 

২.ক্রমবর্ধমান পণ্য চাহিদা 
আঠার শতকের শেষভাগে শিল্প পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এটি সম্ভব হয়েছিল প্রধানত তিনটি কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনগণের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ। ১৭৫০ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল খুবই কম, কিন্তু অত:পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত বাড়তে থাকে। এটি সম্ভব হয়েছিল জন্মের হার বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার ফলে। ১৭৫১ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মােট জনসংখ্যা ছিল ৬.১ মিলিয়ন, ১৮৩১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪.২ মিলিয়নে। বর্ধিত চাহিদা একই সময় জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিপাওয়ায় তাদের ক্রয় ক্ষমতাও বৃদ্ধিপায় । উপরােক্ত দুটি কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশেও উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। বর্ধিত চাহিদা শিল্প বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। 

৩.প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং কয়লা ইঞ্জিনের ব্যবহার 
প্রযুক্তির উন্নয়ন শিল্প বিপ্লবের অপর একটি বড় কারণ। বাষ্প চালিত যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে বড় বড় ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে এবং শিল্পোৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায়। একথা বিশেষভাবে বয়নশিল্পের ক্ষেত্রে সত্য। গুডইয়ার, ফ্যারাডে ও এরিকসনের মত বিজ্ঞানীর আবিষ্কারে শিল্পে নতুন দিক উন্মোচিত হয়। কয়লা ও ইস্পাতের ব্যবহার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। নতুন যন্ত্রপাতি প্রয়ােজনীয় জিনিস তৈরিতে ইস্পাতের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। স্পিনিং জেনি ও যান্ত্রিক মাকু, ওয়াটার ফ্রেম, মিউল মেশিন, পাওয়ার লুম, স্টিম ইঞ্জিন প্রভৃতির কথা না বললেই নয়। অন্যদিকে যাতায়াত ও পরিবহন খাতের উন্নয়ন এই বিপ্লবকে প্রণােদিত করেছিল।

৪.প্রাকৃতিক প্রভাব 
ইংল্যান্ডের প্রাকৃতিকও ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্যগুলি শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হয়েছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন। দেশের স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া বয়ন শিল্পের উন্নয়নে সাহায্য করেছিল, কেননা এর ফলে বয়নের ক্ষেত্রে সুতা ছিড়ে যেতাে না। মাটির নীচে কয়লা ও লােহার অফুরন্ত সঞ্চয় এবং কয়লা ও লৌহ খনিগুলাে পরস্পরের কাছাকাছি হওয়ায় এগুলাের আহরণ সহজ হয়েছিল। দেশের খালগুলি বিভিন্ন নদ-নদীকে যুক্ত করায় জলপথের উন্নয়ন সহজ হয়েছিল। 

৫.বিচ্ছিন্ন কারণ 
অনেক ইতিহাস গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীর ধারণা ইংল্যান্ডে বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, পিউরিটান বিপ্লব, যুক্তিবাদ ও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবােধের উদ্ভব, মুক্তপরিবেশে বিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অগ্রগতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক অবাধ নীতি অনুসরণ শিল্প বিপ্লবের জন্যে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকরেছিল। 

৬.কৃষি বিপ্লবের প্রভাব 
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন কৃষি বিপ্লব ছিল শিল্প বিপ্লবের পূর্বশর্ত। অর্থাৎ কৃষিবিপ্লব ছিল শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা এ বিপ্লবের ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিপায় এবং শ্রমিক হিসেবে কারখানায় নিয়ােগের জন্য জনশক্তির অভাব থাকায় দুইটি খাতের উন্নয়ন সমান্তরালে চলতে থাকে।


শিল্প বিপ্লবের ফলাফল 

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলাফল হয়েছিল ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। ব্যাপক হয়েছিল এই অর্থে যে, দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈদেশিক সম্পর্কে, মানুষে জীবন এবং চিন্তা-চেতনায় প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে এ বিপ্লবের প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, শিল্প বিপ্লবের এ প্রভাব ইংল্যান্ড তথা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এখনও ক্রিয়াশীল রয়েছে। সে অর্থে এ প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। প্রভাবগুলাে নিচে বর্ণনা করা হলাে- 

১.অর্থনৈতিক প্রভাব 
কায়িক পরিশ্রমের পরিবর্তে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উৎপাদনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ফলে আগের তুলনায় শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধিপায়। এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের হাতে যে পরিসংখ্যান রয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে ১৮০১ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত শিল্পোৎপাদন বার্ষিক শতকরা চার ভাগেরও বেশি হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে উক্ত সময়ের মধ্যে ইংল্যান্ডের মােট জাতীয় উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান শতকরা ২৩.৪ ভাগ থেকে ৩৬.৫ ভাগে বৃদ্ধি পায়। অপরপক্ষে কৃষিখাতের উৎপাদনের অবদান শতকরা ৩২.৫ ভাগ থেকে কমে শতকরা ২২ ভাগে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে শিল্পখাতে নিয়ােজিত জনসংখ্যা উক্ত সময়ে যখন শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ৪৩ ভাগে বৃদ্ধিপায় কৃষিকাজে নিয়ােজিত জনসংখ্যা শতকরা ৩৬ ভাগ থেকে ২২ ভাগে নেমে আসে। এভাবে শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্প প্রধান দেশে রূপান্তরিত হয়। সংগে সংগে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধিপায়। ১৭৬০ ও ১৮৫০ সালের মধ্যে আমদানি বৃদ্ধিপায় ১২ গুণ, আর রপ্তানি বৃদ্ধিপায় ১৩ গুণ। আমদানী হতাে কাঁচামাল এবং খাদ্যশস্য, আর রপ্তানি হতাে শিল্পজাত পণ্য। ইংল্যান্ডের শিল্পপণ্য পৃথিবীর সব দেশে রপ্তানি হতাে এবং এজন্য ইংরেজদের বলা হতাে দোকানদার জাতি। একই সংগে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। এভাবে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি, খনিজ সম্পদের উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণও বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এর প্রধানতম প্রমাণ হলাে মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি। এক কথা আয়ের বন্টনের ক্ষেত্রে দারুণ বৈষম্যের সৃষ্টিহয়; কিন্তু মাথাপিছু আয় যে বৃদ্ধিপেয়েছিল সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। এ প্রসংগে উল্লেখ্য যে, তখনকার দিনে ইংল্যান্ডের কৃষিখাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন চলছিল। 

২.পুঁজিবাদের উদ্ভব 
ব্যপক শিল্পায়ন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে। এই ব্যবস্থায় যে মূলধনের প্রয়ােজন হয় তা সংগৃহীত হয় পুঁজিপতি কর্তৃক। এভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার সবটায় পুঁজিপতিদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদিত পণ্য দেশে-বিদেশে বিক্রি করে তারা লাভবান হয় এবং এভাবে সঞ্চিত মূলধনদ্বারা আরও নতুন শিল্প গড়ে তােলে। একই সংগে নতুন পুঁজিপতিরা কারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসে। এভাবে শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থার পূর্ণ মালিকানা পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়। শিল্প বিপ্লবের ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় কারখানা গড়ে উঠে এবং এসব কারখানায় গ্রাম থেকে আগত বিপুলসংখ্যক মানুষ শ্রমিক হিসেবে নিয়ােজিত হয়। ফলে দেশে নতুন নতুন শহর গড়ে উঠে এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পুরাতন শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এসব শহরের মধ্যে ম্যানচেস্টারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এ শহরটি ছিল বয়নশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। এভাবে দেশের মােট জনসংখ্যায় শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যা আনুপাতিকভাবে বেড়ে যায়। এক হিসেব মতে আঠার শতকের মধ্যভাগে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ শহরে বসবাস করত। জনসংখ্যা বৃদ্ধিপেয়ে ১৮০১ এবং ১৮৪১ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৫ ও ৬০ ভাগে। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী জনসংখ্যা দ্রুত কমে যায়, কোনাে কোনাে এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। 

৩.সামাজিক প্রভাব 
শিল্প বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়াশ্রেণী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। কেননা ধনী ব্যবসায়ী এবং উঠতি শিল্পপতিদের প্রায় সবাই ছিল বুর্জোয়াশ্রেণীভূক্ত। অভিজাত শ্রেণী এতদিন যে ক্ষমতা ভােগ করে আসছিল তা লােপ পায়নি সত্য, কিন্তু আগের তুলনায় তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যায়। একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণী প্রাধান্য বিস্তার করে। ইংল্যান্ডে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে। 

৪.শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব 
শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব শিল্প বিপ্লবের অন্যতম একটি দিক। নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠলে গ্রাম ছেড়ে অনেকে শহরে এসে শ্রমিক হিসেবে জীবনযাত্রা শুরু করে। এভাবে ভূমিহীন, চাকুরি-সম্বল শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এরা কারখানায় কঠোর পরিশ্রম করে কম মজুরিতে জীবিকা নির্বাহ করতাে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে একার উপার্জনে সংসার চলতাে না বলে নারী ও শিশুদেরকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হতাে। কারখানাগুলাে নােংরা, অস্বাস্থ্যকর এবং যন্ত্রপাতিগুলাে এমনভাবে রাখা হতাে যে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতাে। এ অবস্থায় শিশু ও নারী শ্রমিকদের ১৬-১৭ ঘন্টা পরিশ্রম করতে হতাে। শ্রমিকদের বাসস্থানও ছিল একইভাবে নােংরা ও অস্বাস্থ্যকর। বলা যেতে পারে তারা বস্তিতে বসবাস করতাে। শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক যুগে শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশারকথা সমকালীন অনেক লেখায়, এমনকি সরকারি প্রতিবেদনেও পাওয়া যায়। এভাবে শিল্প বিপ্লবের ফলে একদিকে যেমন ধনী পুঁজিপতিও ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হয় অপর দিকে দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক শ্রেণী ও গড়ে উঠে। 

৫.সমাজতান্ত্রিক মতবাদ 
চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা সমাজে সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে এরূপ বৈষম্য এবং শ্রমিকদের দারিদ্র্যের কথা ভেবে এর প্রতিকারের চিন্তা করেন। তাঁরা এ মর্মে মত প্রকাশ করেন যে, শ্রমই হলাে সম্পদের উৎস, আর কাঁচামাল প্রাকৃতিক সম্পদ। এতে সকলের সমান অধিকার রয়েছে। শ্রমিক কাঁচামালকে ভিত্তি করে তার শ্রমের দ্বারা যা উৎপাদন করে তার মুনাফা শ্রমিকেরই প্রাপ্য। কারখানার মালিক প্রকৃতপক্ষে মুনাফার দাবিদার হতে পারে না। রাষ্ট্রের উচিত শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরণের মাধ্যমে শ্রমিকের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এভাবে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের বিকাশ ঘটে, আর এ মতবাদের প্রধান তাত্ত্বিক প্রবক্তা হলেন কার্ল মার্কস। 

৬.রাজনৈতিক প্রভাব 
শিল্প বিপ্লবের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। এক্ষেত্রে অনেকগুলাে দিক শনাক্ত করা যায়, যার দ্বারা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলােচিত হওয়ার দাবি রাখে। প্রথমত, রাজনৈতিক অঙ্গনেও শিল্প বিপ্লবের গুরুত্ব ও প্রভাব অনুভূত হয়। শিল্পপতি ও বণিকদের যে শ্রেণী শক্তিশালী হয় তার ফলে ভূস্বামীও হুইগ রাজনীতিকদের একচেটিয়া অধিকার লােপ পায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমে পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্যে শ্রমিক শ্ৰেণী সংঘবদ্ধ করার প্রয়ােজনীয়তা উপলদ্ধি করে এবং ফলে ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন শুরু হয়। একই লক্ষ্যে শ্রমিক দল গঠিত হয়। শ্রমিক শ্রেণী ধর্মঘট প্রভৃতির মাধ্যমে মালিকের নিকট তাদের দাবি পেশ করে। ফলে নিম্নতম মজুরী, কর্মক্ষেত্রে শ্রম ঘন্টা, বাসস্থান, বীমা প্রভৃতি আইন পাশ হয়। এক পর্যায়ে শ্রমিক শ্রেণী ভােটাধিকার লাভ করে। তৃতীয়ত, শিল্প বিপ্লবের ফলে পার্লামেন্টের সংস্কারের আশু প্রয়ােজন দেখা দেয়। কারণ এর ফলে অনেক নতুন শহর গড়ে উঠে এবং অনেক পুরাতন শহর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এতে জনসংখ্যার ঘনত্বে ব্যাপক রদবদল হয় এবং এজন্যে পার্লামেন্টের সংস্কারের প্রয়ােজন দেখা দেয়। চতুর্থত, বেশি মুনাফার লােভে শিল্পপতিরা দেশের প্রয়ােজনের তুলনায় বাড়তি পণ্য উৎপাদন করে। এ বাড়তি পণ্য বিক্রির জন্যে বিদেশে বাজার দখলের প্রয়ােজন দেখা দেয়। শিল্প বিপ্লবের আগেই ইউরােপীয় দেশগুলাের মধ্যে উপনিবেশ স্থাপনের লক্ষ্যে প্রতিযােগিতা শুরু হয়েছিল। এবার সে প্রতিযােগিতা আরও তীব্র আকার ধারণ করে। প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে, ইরােপের অন্যান্য দেশেও শীঘ্রই শিল্পোন্নয়ন শুরু হয়েছিল।

তথ্যসূত্র : 
বই : সমাজকর্ম।
লেখক : তৌফিক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবীর।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন