আল গাযালী (রহ:) জীবন ও কর্ম

আবু হামিদ আল গাজ্জালি'র জীবনী - Biography of Abu Hamid Al-Ghazali - bongotweet.com

আল গাযালী ছিলেন মুসলিম উম্মাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিন্তানায়ক। দার্শনিক এবং ধর্ম শাস্ত্রবিদ। তার পুরাে নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তুসী আশ-শাফিঈ। 

৪৫০ হিজরী মােতাবেক ১০৫৮ ইংরেজী সনে আল-গাযালী তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি নায়সাবুর নগরে ইমামুল হারামাইন আল জুয়ায়নীর কাছে শিক্ষা লাভ করেন এবং তার ইন্তেকাল অবধি ৪৭৮ হি:/১০৮৫ ইং পর্যন্ত তিনি তার সাথেই ছিলেন। 

জীবনের প্রারম্ভ হতেই তার মধ্যে সংশয়ের মনােভাব পরিলক্ষিত হয়। সূফী পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবাধীন থেকে সূফী ক্রিয়া কলাপ অনুসরণ করা সত্ত্বেও তখন সূফী মনােভাব তার মনে শিকড় গাড়তে পারেনি। তিনি আকাঈদ এবং ফিকাহর সুক্ষ বিষয়াদি সম্পর্কে গবেষণা করতে ভালবাসতেন। তখন তার বয়স বিশ বৎসরও হয়নি। তিনি প্রথম জীবনেই তাক্বলীদ/মাযহাব অনুসরণ পরিত্যাগ করেছিলেন। 

নায়সাবুর ত্যাগ করে তিনি সালজুক ওয়াযীর নিযামল মুলক এর দরবারে আইনজ্ঞ আলিম হিসেবে আমাত্য পদ গ্রহণ করেন। এ পদে তিনি ৪৮৪হি:/১০৯১ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। এরপর তিনি বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি শুধু ধর্ম তত্ত্ব নয় বরং নিশ্চিত জ্ঞান লাভের ব্যাপারে পুরােপুরী সংশয়বাদী হয়ে উঠেন। দর্শনশাস্ত্রে তিনি কোন দিনই সংশয়বাদ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। 

বাগদাদে তিনি ফিকাহ বিষয়ে অধ্যাপনা ও গ্রন্থ রচনা করতেন। ফিরকায়ে বাতিনিয়্যা, ইমামিয়া ও ইসমাইলিয়া তখন বেশ তৎপর ও জঙ্গিরূপ ধারণ করে। ৪৮৫/১০৯২ সালে নিযামুল মুলক ও সারিকশাহ এদের হাতে নিহত হন। 

গাযালী এদের বিরুদ্ধে কয়েকটি বিতর্কমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। ধর্মীয় ও বুদ্ধিলব্দ জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধনে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। ৪৮৩ হি: থেকে ৪৮৭ হিজরী পর্যন্ত সমসাময়িক বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে অধ্যয়ন করেন। পরিশেষে তিনি সর্বান্ত করণে সূফী সাধনার দিকে মনােনিবেশ করেন। নিছক বুদ্ধিবৃত্তি তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারেনি। সূফী সাধনালব্দ অভিজ্ঞতার ফলে তিনি আল্লাহ নুবুওয়াত এবং আখেরাত সম্পর্কীয় বিশ্বাসে পুন:প্রতিষ্ঠিত হন। 

৪৮৮ হিজরীর রজব মাস হতে জিলকাদা মাস পর্যন্ত তিনি আল্লাহর ভয়জনিত মানসিক পরিবর্তনের তীব্র বেদনা অনুভব করেন যাতে তার শারীরিক ও মানসিক | বিপর্যয় ঘটে। অবশেষে যুলকাদা মাসে পার্থিব উচ্চাকাঙ্খ ও প্রতিভাবানের মর্যাদা পরিত্যাগ করে বাগদাদ ছেড়ে তিনি দরবেশের বেশে বের হন এবং সংসার ত্যাগী ভ্রাম্যমান সাধকের জীবন গ্রহন করে আত্মার শান্তি ও নিশ্চিত জ্ঞানের সন্ধানে লিপ্ত হন। এই সাধনায় তিনি সাফল্য লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি প্রয়ােগবাদী মনােভাবে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি প্রচার করতে থাকেন যে, বুদ্ধিবৃত্তির উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপনের প্রবণতাকে বিনষ্ট করার কাজেই বুদ্ধি বৃত্তি প্রযুক্ত হওয়া উচিত এবং অভিজ্ঞতা প্রসূত জ্ঞানই একমাত্র নির্ভরযােগ্য জ্ঞান।

তার মতে চিন্তাশ্রয়ী ধর্মতত্ত্ববিদগণের পদ্ধতির মধ্যেও কোন বুদ্ধিবৃত্তিক নিশ্চয়তা নেই। যদিও তাদের মতবাদ সত্য দূরকল্পী যুক্তির সাহায্যে কোন দার্শনিক মতবাদ প্রমাণ করা যায়না। আল্লাহ যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান দ্বারা মানুষের হৃদয়কে প্রাবিত করেন কেবল সেই জ্ঞান দ্বারাই তা উপলব্দি করা যায়। এ ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা নবীগণের নিকট অবতীর্ণ ওহীর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং যথার্থ আকাঈদ তত্ত্ব নির্ধারণ করা যায়। 

এখানে একথা নি:সন্দেহে বলা যায় যে গাযালীর চিন্তাধারা তার দার্শনিক অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানের ফলে সস্পষ্টতা লাভ করেছে এবং তার সাহচর্যে গ্রীক যুক্তিতর্কের রীতি পদ্ধতি অবশেষে মুসলিম চিন্তা জগতে স্বীকৃতি লাভ করে। আবুল হাসান আশআরী যে কাজ অনেকটা অর্ধ সচেতনভাবে আরম্ভ করেছিলেন গাযালী তা পূর্ণ জ্ঞানের সমাপ্ত করেন। তাছাড়া গ্রীক যুক্তি প্রণালী ব্যবহার করে তিনি স্বকীয় মৌলিকতা বলে একটি প্রয়ােগিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী ধর্মশাস্ত্রবিদগণ তার ভাবধারা কখনাে কখনাে বুঝতে পারেননি। ফলে অনুসরণ করেননি। আল মুনকিয-মিনদ দালাল গ্রন্থে তিনি নিজে এ সম্বন্ধে যে বিবরণ লিখে গেছেন তা যথার্থ। ব্যক্তিগতভাবে গাযালীর নিজের জন্য এবং ইসলামী চিন্তাধারার বিকাশের জন্য দর্শনের প্রয়ােজন ছিল সুস্পষ্ট। 

৪৮৮হি:/১০৯৫ সালে বারকিয়ারূক সালজুক শাসনকর্তা হন। গাযালী স্বাভাবিক কর্মজীবন ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক তত্ত্বানুসন্ধানে বের হবার কিছু দিন পূর্বে বারকিয়ারূক তার চাচা তুতুশকে হত্যা করেন। যে খলীফার দরবারে গাযালী উচ্চ পদে আসীন ছিলেন সে খলীফা দরবারে তুতুশের পক্ষাবলম্বন করেন। ৪৯৯হি:/১১০০৫ সালে তিনি পুনরায় কর্মজীবনে প্রবেশ করার পূর্বে ৪৯৮ হিঃ বারকিয়ারূক মারা যান। এর আগে প্রায় দু বছর গাযালী সিরিয়াতে অবসর জীবন যাপনের পর ৪৯০হি:/১০৯৭ সালের শেষ ভাগে মক্কায় হজ্জ করতে যান। এরপর নয় বছর তিনি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ান। এ সময়ে মাঝে মধ্যে তিনি পরিবার পরিজনের সাহচর্যে আসতেন এবং জাগতিক কাজকর্ম করতেন। এ সময় কালেই তিনি “ইয়াহইয়া উল উলুমিদ দ্বীন” সহ আরাে কয়েক খানা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন এবং বাগদাদে এর প্রচার কাজ চালান। সেই সাথে বাগদাদ ও দামেস্কে 'ইয়াহইয়া’ গ্রন্থের আলােকে অধ্যাপনা করেন। 

তকালীন সুলতান তাকে নায়সাবুরের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপক পদ গ্রহণে বাধ্য করেন। ৪৯৯হি:/১১০৫ এর যুলকাদা মাসে এ পদ গ্রহণে তিনি সম্মত হন। এ সময় প্রবল সংস্কার প্রচেষ্টার প্রয়ােজন ছিল। গাযালী তা উপলব্দি করেন। তিনি এমন একজন ধার্মিক শাসকের একান্ত প্রয়ােজন উপলব্দি করেন যার কর্তব্য হবে নাস্তিকতা এবং অবিশ্বাস দূরীভূত করা। বারকিয়ারূকের ভাই মুহাম্মদই ছিলেন এর জন্য উপযুক্ত। তিনি ৪৯৮হি:/১১০৪ সালে সালজুক প্রধান হন। ইমাম গাযালী মুহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে ফার্সী ভাষায় ‘তিবরুল মাসবুক' নামে একখানা গ্রন্থ লিখেন। যাতে রাজা বাদশাহগণের জন্য নৈতিক নির্দেশাবলী বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গাযালীকে পুনরায় কর্মক্ষেত্রে আহবান করার মূলে ছিল তার সাবেক পৃষ্ঠপােষক নিযামুল মুলকের পুত্র ফাখরুল মুলকের প্রভাব। তিনি নায়সাবুরে খুরাসানের শাসন কর্তা সানজারের মন্ত্রী ছিলেন। 

ইমাম গাযালী (রহ:) দীর্ঘ দিন রাজ দরবারে অবস্থান করেননি। নির্জনবাস ও ধ্যান সাধনার প্রতি গভীর আগ্রহ তাকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে তিনি তুস নগরে ফিরে যান এবং কয়েকজন বিশেষ অনুরক্ত শিষ্য সহ, নির্জনবাস আরম্ভ করেন। সেখানে একটি মাদ্রাসা ও একটি খানকাহ এর ভার গ্রহণ করেন। ৫০৫ হি: ১৪ জুমাদাছ ছানিয়া /১১১১ খৃঃ ১১ ডিসেম্বর তিনি ইন্তিকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন) 

গাযালী ইন্তেকাল করলেও তার দর্শন রচনাবলী ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা বিগত হাজার বছর যাবৎ মুসলিম প্রজন্মকে আন্দোলিত করেছে, মানব সভ্যতাকে করেছে সমৃদ্ধ। আগামীতেও যুগ যুগ ধরে এর প্রভাব প্রতিফলিত হবে এতে সন্দেহ নেই।

লেখক: শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন