হিব্রু সভ্যতার ইতিহাস - History of Hebrew civilization

হিব্রু সভ্যতার ইতিহাস - History of Hebrew civilization

হিব্রুগণ সেমেটিক জাতির অন্যতম শাখা। তারা সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করে। কিন্তু কালক্রমে তারা বিলুপ্ত হয়ে ফিনিসীয়, আরামীয় এবং হিব্রু নামে অভিহিত হয়। ফিনিসীয়গণ লেবাননে বসতি স্থাপন করে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে জীবিকা অর্জন করতাে। আর আরামীয়গণ সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করে। আসলে আরামীয়গণ ফিনিসীয়গণের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদের বর্ণমালা গ্রহণ করে এক উন্নত ভাষা সৃষ্টি করেছিল। সিরিয়া, ইরাক, জেরুজালেম প্রভৃতি স্থানের অধিবাসিগণ তাদের ভাষায় কথা বলতাে। 


হিব্রু সভ্যতার রাজনৈতিক ইতিহাস 

ইব্রাহীম (আ) : প্রাচীন ইসরাইলিগণ ইতিহাসে হিব্রু বা ইহুদি জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তারা নিজেদেরকে ইব্রাহীম (আ)-এর বংশধর বলে দাবি করতাে। তারা প্রথমদিকে যাযাবর ছিল। বহুদিন ধরে আবাসস্থলের সন্ধান করতে করতে তারা আরবের মরুভূমি অতিক্রম করে কেনানে অর্থাৎ প্যালেস্টাইনে এসে বসতি স্থাপন করে ( খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০–১২০০ অব্দ)। তাদের একটি শাখা মিশরে ফেরাউনের দাসত্ব হতে হযরত মুসার (আ) সাহায্যে মুক্তি লাভ করেছিল। গােড়ার দিকে তারা প্রথমে পুরােহিত দ্বারা শাসিত হতাে। গােত্রকলহ বিদ্যমান থাকায় তাদের মধ্যে একতা ছিল না। ফলে তারা ফিলিস্তিনীদের কাছে বার বার নাজেহাল হতাে।

সউল ও দাউদ (আ) : সউল তাদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলােকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী রাজ্যের গােড়াপত্তন করে। সউলের উত্তরাধিকারী ডেভিড বা দাউদ (আ) খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে জেরুজালেম রাজ্যকে আরও উন্নত করেন। তিনি প্রসিদ্ধ কবি এবং সুদক্ষ যােদ্ধা ছিলেন। তিনি বিবদমান হিব্রু গােত্রগুলােকে সংঘবদ্ধ করে হিব্রুদেরকে সুসংহত জাতিতে পরিণত করেন।

সােলেমান (আ) : দাউদ (আ)-এর উত্তরাধিকারী সােলেমান (আ)-এর আমলে হিব্রু রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে উপনীত হয়েছিল। তিনি ছিলেন পরাক্রমশালী নবী এবং শ্রেষ্ঠ নরপতি। তিনি জেরুজালেমকে সুরম্য সৌধরাজি দ্বারা মনােরম শহরে পরিণত করেছিলেন। তিনি অনেক দুর্গ নির্মাণ করেন এবং আকাবা উপসাগরে একটি শক্তিশালী নৌ-বাহিনী প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আরবের সাবাহ প্রদেশের রাণী বিলকিস বেগমকে তিনি বিবাহ করেছিলেন। সমসাময়িক জগতে তিনি বিজ্ঞ রাজা (Wisest King) নামে পরিচিত ছিলেন। তার ইন্তেকালের পর জেরুজালেম রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হয়ে উত্তরে ইসরাইল এবং দক্ষিণে জুদাহ রাজ্যে বিভক্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে অ্যাসিরীয়গণ হিব্রু রাজ্য এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৬ অব্দে ক্যালদিয়ান রাজা নেবুচাদনেজার জুদাহ রাজ্য অধিকার করেন। 


হিব্রু সভ্যতার ধর্ম বিশ্বাস

ধর্মশাস্ত্রে তাদের একেশ্বরবাদিতার মতবাদের জন্য তারা প্রাচীনকালের অন্ধকার যুগেও আলােকবর্তিকা হয়ে রয়েছে। তৌরাত বা ওল্ড টেস্টামেন্ট তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম। এর ১০টি অনুশাসনের ভিত্তিতে তাদের নৈতিক মান নির্দিষ্ট হতাে। তাদের মতে তাদের দেবতা যিহােভা মানব জাতিকে সৎপথে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সিনাই পর্বতে মুজেজের [মুসা (আ)] হাতে এর ধর্মীয় নির্দেশাবলি প্রদান করেছিলেন। তাদের ধর্মগ্রন্থ হতে তাদের খামার জীবন ও দুঃখ-কষ্টের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অবগত হতে সক্ষম হই। ঐতিহাসিক দিক থেকে হিব্রু জাতির একেশ্বরবাদ-এর সাথে পরবর্তীকালে খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদের মিল দেখা যায়। পবিত্র কুরআনে বিবৃত হয়েছে যে, ইহুদিগণের মধ্যে অনেক নবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। 


হিব্রু সভ্যতার শিক্ষা-সংস্কৃতি

আইন, সাহিত্য, দর্শন ও স্থাপত্য শিল্পের বিকাশে তাদের কৃতিত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তাদের আইন ব্যবস্থা হাম্মুরাবি কোড অপেক্ষা উন্নততর ছিল। এতে অসহায়দের স্বার্থরক্ষা, দাসমুক্তি এমনকি সুদ গ্রহণের জন্যও শাস্তির বিধান ছিল। এ যুগে সাহিত্য দর্শনেও অগ্রগতি সাধিত হয়। রাজা দাউদ (আ) ও সােলেমান (আ) নিজেরাই প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। ধর্ম, বীরত্ব গাঁথা, যুদ্ধ, প্রেম ইত্যাদি ছিল হিব্রু সাহিত্যের বিষয়বস্তু। 'জবের পুস্তক’ হিব্রু সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এছাড়া 'মৃত সাগর দস্তাবেজ' তাদের ধর্মীয় সাহিত্যের একটি উল্লেখযােগ্য নজির। এটি ১৯৪৭ সালে আবিষ্কৃত হয়। হিব্রু জাতি স্থাপত্য কীর্তিরও অসংখ্য নিদর্শন রেখে গেছে। সৌধরাজি সুশােভিত সােলেমানের (আ) জেরুজালেম তৎকালীন বিশ্বে বিস্ময়ের উদ্রেক করতাে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে হিব্রু জাতির অবদান অনস্বীকার্য। 


হিব্রু সভ্যতার মূল্যায়ন ও প্রভাব

ধর্মীয় ক্ষেত্রে হিব্রুদের অসামান্য অবদান পরিলক্ষিত হয়। খ্রিস্টের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্ট (তৌরাত) পাশ্চাত্য সভ্যতার নিকট একটি মহামূল্যবান বস্তু হিসেবে পরিগণিত হতাে। একেশ্বরবাদ সম্পর্কে তাদের ধারণা সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের বিশ্ববাসীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
 

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কেও তাদের দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। তারা মনে করে যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটি সুনির্দিষ্ট পবিত্র ও মূল্যবান বস্তু রয়েছে তা কখনই অপরের দ্বারা লঙ্ঘিত হতে পারে না। এভাবে তারা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এক কথায়, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং স্থাপত্য শিল্পের বিকাশে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতিসমূহের সভ্যতা বিকাশের ইতিহাসে হিবু সভ্যতার প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।


তথ্যসূত্র : 
বই : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : হাসান আলী চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন