বাংলা ভাষার উৎপত্তি

বাংলা ভাষার উৎপত্তি | বাংলা ভাষার উদ্ভব কোন ভাষা থেকে | বাংলা ভাষার আদি নিদর্শনের নাম কি | বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে কোন ভাষা থেকে | বাংলা ভাষার উৎপত্তি কোন ভাষা থেকে | বাংলা ভাষার ইতিহাস | bongotweet.com

বাঙালি সম্প্রদায় বাগযন্ত্র সৃষ্ট যে ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা একে অপরের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করে তাই বাংলা ভাষা। বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যের মুখ্য ভাষা বাংলা। মিয়ানমারের আরাকানেও বাংলা ভাষা প্রচলিত। এ ছাড়া ইউরােপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলে। সম্প্রতি সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশের রেডিও-টেলিভিশনে। নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে বাংলা অনুষ্ঠান, এ ছাড়া প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ভাষায় নানারকম পত্রিকা। এভাবে বাংলা ক্রমেই বৈশ্বিক ভাষায় পরিণত হতে চলেছে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাভাষী জনগােষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ কোটি এবং ভাষা ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে এ ভাষার অবস্থান চতুর্থ। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষা একটি বিশেষ দিক থেকে মর্যাদা দাবি করতে পারে। আর তা হলাে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি এ ভাষার মর্যাদা আদায় করেছে।

আত্মমর্যাদাশীল ও বিশ্ব বিস্তারি বাংলা ভাষা সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিশ্বের যাবতীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে হাতেগােনা কয়েকটি ভাষাগােষ্ঠী থেকে। তাদের মধ্যে একটি হলাে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠী। এই ভাষাগােষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে অনেকগুলাে ভাষার। আর ওই ভাষাগুলােই বর্তমান বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচলিত ভাষা। বাংলা ভাষাও ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীরই অংশ। এখন থেকে প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে এ অঞ্চলে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা। জনবিস্তৃতির ফলে ইউরােপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লােকজন যে যার সুবিধেমতাে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিজেদের স্থায়ী আবাস নির্ধারণ করতে থাকে। 

তেমনি ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর একদল মানুষ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে, যাদের ভাষা ছিল আর্য। ভারতীয় জাতিসত্তার দিক থেকে আর্যরা বহিরাগত। তবুও আভিজাত্য ও কৌলিন্যে তারা ভারতীয়দের শীর্ষেই অবস্থান করত। স্থানীয় অনার্য অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অধিগত করে আর্যরা তাদের স্বভাষারই (আর্যের) আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে সে আধিপত্য ক্ষুদ্র হতে থাকে। কারণ ভাষাকে কখনাে শৃঙ্খলিত করে রাখা যায় না। জলবায়ুগত প্রভাব ও অনার্যদের অবাধ প্রয়ােগের কারণে আর্য ভাষায় দেখা দিল মিশ্রণ। এই মিশ্রণের ফলে ভাষা তার স্বাভাবিক মান হারাতে লাগল। প্রয়ােজন দেখা দিল ভাষা শাসন বা সংস্কারের। খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে শুরু হলাে ভাষা শাসনের কাজ। উদ্দেশ্য সর্বজনগ্রাহ্য একটি মান ভাষার প্রচলন করা। অতঃপর খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে পাণিনি (পৃথিবীর অন্যতম আদি ব্যাকরণবিদ) তাঁর ‘অষ্টাধ্যায়ী' নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ভাষাকে সংস্কার করে একটি মান্য ও পরিশীলিত রূপ দেন। এই সংস্কারজাত ভাষার নতুন নামই সংস্কৃত ভাষা। 

যেহেতু ভাষা হলাে প্রবহমান নদীর মতাে তাই এই সংস্কারজাত সংস্কৃত ভাষা কেবল উচ্চবিত্ত বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না। মানুষের চিরায়ত মুখের ভাষা ভারতে নানা অঞ্চলে নানা রূপ নিয়ে বিস্তার লাভ করতে লাগল, যার নাম ‘প্রাকৃত' অর্থাৎ প্রাকৃতজনের মুখের ভাষা বা সাধারণ জনগণের কথ্য ও বােধ্য ভাষা। 

পরে এই ‘প্রাকৃত ভাষা ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাবে ও উচ্চারণের ভিন্নতায় নানা রূপ ধারণ করতে থাকে। যেমন মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত, অর্ধমাগধি প্রাকৃত, মাগধি প্রাকৃত, গৌড়ি প্রাকৃত ইত্যাদি। 

গৌড়ি প্রাকৃত থেকেই অপভ্রংশের (বিকৃতের) মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন 'চর্যাপদে’ প্রাচীন বাংলা ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়।

ক্রমান্বয়ে মধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, রােমান্টিক প্রণয়ােপাখ্যান ও লােকসাহিত্যের (মৌলিক ঐতিহ্যের) ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা ক্রমেই বিকশিত হয়। উনিশ শতকে পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ মুদ্রণের ভেতর দিয়ে বাংলা ক্রমেই একটি সমৃদ্ধ ভাষার রূপ লাভ করতে থাকে।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন