রােমীয় সভ্যতার ইতিহাস - History of Roman civilization

রােমীয় সভ্যতার ইতিহাস - History of Roman civilization - Bongo Tweet

গ্রিক সভ্যতা যখন বিকাশের উচ্চস্তরে প্রবেশ করেছিল তখন ভূমধ্যসাগরের মধ্য অঞ্চলে এ্যাপেনাইন উপদ্বীপ তথা ইটালী উপদ্বীপকে আশ্রয় করে আর একটি সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। এটিই সুবিখ্যাত রােমীয় সভ্যতা। টাইবার নদীর বাম তীরের মােহনা থেকে ১৫ মাইল অভ্যন্তরে প্রাচীন রােমক ঐতিহাসিকদের মতে ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রােম নগরী স্থাপিত হয়েছিল। লােকশ্রুতি অনুসারে নির্বাসিত দুই রাজপুত্র রােমুলাস এবং রেমাস সিংহাসন পুনরাধিকার করে রােম নগরী নির্মাণ করেন। রােমুলাসের নামানুসারে রােম নগরীর নামকরণ করা হয়। 

রােমীয় বা রােমান সাম্রাজ্য

সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকা, দক্ষিণ ইউরােপ, আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলের সীমানা এবং নিকট প্রাচ্যের একটি বিরাট অংশ নিয়ে রােমান সাম্রাজ্য গঠিত ছিল। এ রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ইটালি উপদ্বীপটি দৈর্ঘ্যে ৬৫০ মাইল এবং প্রস্থে ১০০ মাইল। দেশটির আবহাওয়া বড়ই সুন্দর। গুরুত্বপূর্ণ ভৌগােলিক অবস্থানের ফলে ইটালি বহু দেশের সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহের ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছিল। 


সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস 

সম্রাট কনসটানটাইন (৩২৪–৩৩৭ খ্রি.) গােটা রােমান সাম্রাজ্যের অখণ্ডত বজায় রাখেন। তার পরেও ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অখণ্ডতা অক্ষুন্ন থাকে। অতঃপর থিওডােসিয়াস এবং তার পুত্রের শাসনামলে সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বিনষ্ট হয় এবং পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য রােমান সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায় কনসটানটাইন হতে শুরু করে একমাত্র সম্রাট জুলিয়ান ব্যতীত অন্যান্য সকল সম্রাটই খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। (সম্রাট হিরাক্লিয়াসের (৬১০-৬৪১ খ্রি.) শাসনামল অবধি রােমানদের রাষ্ট্রভাষা ছিল ল্যাটিন। পরবর্তীতে সেদেশে গ্রিক ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।) প্রথম ও দ্বিতীয় থিওডােরাসের পর প্রথম জাসটিনিয়ন (৫২৭–৬৫) রােমান সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। রােমান সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং রােমান আইনের সংকলন ও প্রকাশনা ছিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। ঐতিহাসিক মায়ার্স বলেন, "এ আইন বিশ্বের নিকট রােমের প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ সম্পদ।” পরবর্তী প্রসিদ্ধ রােমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস মহানবি (স) কর্তৃক প্রেরিত দূতকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। রােমান সম্রাটদের মধ্যে অগাস্টাস ছিলেন আর একজন উল্লেখযােগ্য সম্রাট। তিনি ট্রিবিউনের ক্ষমতা এবং কনসালদের প্রতিপত্তিকে নিজ কর্তৃত্বাধীনে আনয়ন করেন। তাঁর সময় প্রদেশগুলাে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা—
  1. সম্রাটের অধীন প্রদেশ এবং এগুলাে সম্রাট কর্তৃক নিয়ােজিত গভর্নর দ্বারা শাসিত হতাে এবং 
  2. পরিষদের অধীন প্রদেশ এবং এগুলাের শাসনভার ন্যস্ত করা হয়েছিল পরিষদ নিয়ােজিত গভর্নরের উপর।


রোমান সাম্রাজ্যের পতন

রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত ৭০ জনেরও অধিক সম্রাট রাজত্ব করেন। পরবর্তীকালে দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ এবং সম্রাটদের ঘন ঘন পরিবর্তনের জন্য এ বিশ্ববিখ্যাত সাম্রাজ্য সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে—“ক্রীতদাস, সেনাবাহিনী ও শ্রমিক সবকিছুর অভাব ঘটেছিল পরবর্তীকালে মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা ও জঘন্য দাসপ্রথা রােমের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।” পরিশেষে, হুনদের দুর্ধর্ষ সেনাপতি বা প্রধান নেতা এটিলার হামলায় রােমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। 


রােমীয় সভ্যতার শাসন সংস্কার

রােমান রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন স্বয়ং সম্রাট। তিনি ছিলেন জনগণের পিতা। তিনি ছিলেন জাতির শাসক, সেনাবাহিনীর প্রধান, প্রধান বিচারক এবং জনগণের সর্বোচ্চ পুরােহিতও বটে। অপরাধীকে তিনি যে কোনাে ধরনের শাস্তি এমনকি মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত করতে পারতেন। সম্রাটের পরেই ক্ষমতার অধিকারী ছিল ‘সিনেট’। সিনেট সম্রাটকে সর্বদা পরামর্শ প্রদান করতাে। দেশে ‘পপুলার এসেম্বলী’ ছিল। এটি ফ্রি নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত হতাে। পপুলার এসেম্বলী শাসনসংক্রান্ত বিষয়ে এবং নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে ছিল আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। রােমান নাগরিকগণ প্রাইভেট এবং পাবলিক এ দুই প্রকারের অধিকার লাভ করতাে (যদিও দেশে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল)। 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে রােমে রাজতন্ত্র উৎখাত করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর রােমে শাসন সংস্কার প্রবর্তিত হয়। রাজার বা সম্রাটের পরিবর্তে দুজন সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত হতেন—এদের বলা হতাে কনসাল। সিনেট ছিল রােম প্রজাতন্ত্রের মূল ক্ষমতার আধার। তিন শ’ গােত্রপ্রধান ছাড়াও সাবেক কনসালগণ ও অন্যান্য পদস্থ কর্মচারীরা সিনেটের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ের রােমান প্রজাতন্ত্রে শুধু অভিজাত শ্রেণির লােকেরাই সিনেট সদস্য, কনসাল ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতেন। রাজন্ত্র অবসানের পূর্বেই রােমের জনগণ প্যাট্রিশিয়ান এবং প্রিবিয়ান এ দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। এ বিভক্তির ফলে রােমে গৃহযুদ্ধ, দাস বিদ্রোহ ইত্যাদি সংঘটিত হয়। এরূপ গৃহযুদ্ধ রােমে বহুকাল ধরে চলে। সিজারের ক্ষমতা লাভ, তৎপর এন্টনী ও অকটেভিয়ানের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রােমান সাম্রাজ্যকে দ্বিধাবিভক্ত ও প্রকম্পিত করে তােলে। অকটেভিয়ান বা অগাস্টাস ও সিজারের শাসনামলে রােম এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে এবং এর সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। 


রােমান সাম্রাজ্যের আইন

ঐতিহাসিক মায়ার্স বলেন, “আমরা অবশ্য মনে করি যে, নৈতিক অথবা বিচার সংক্রান্ত বিজ্ঞানে রােমানগণ ছাত্র নয় বরং শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। মানুষের ন্যায় জাতিরও লক্ষ্য বা মিশন থাকে। রােমের মিশন ছিল বিশ্বকে আইন প্রদান করা।” 

(খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যভাগে রােমানরা তাদের প্রচলিত দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনগুলাে একত্রে সংকলিত করে। এগুলাে বারােটি কাঠের ফলকে খােদিত করে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দেয়া হতাে। এগুলােকে বলা হতাে “দ্বাদশ সারণি বা তালিকা” [Twelve Tables]) কিন্তু এ আইনগুলাে ছিল আদিম, কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রয়ােজন মিটাবার উপযােগী। এগুলাে ক্রমপ্রসারমান আধুনিক রােমান রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণে ক্রমশ ব্যর্থ হচ্ছিল। তাছাড়া শুধু রােমান নাগরিকদের ক্ষেত্রেই এগুলাে প্রয়ােগ করা হতাে বা যেত। 

কিন্তু পরবর্তীকালে প্রবর্তিত সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপযােগী এবং ক্রমশ বিস্তৃত রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য নাগরিকদের জন্যও একটি নতুন আইন ব্যবস্থার প্রয়ােজন দেখা দেয়। 'দ্বাদশ টেবিলকে' পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত করে একে উদার ও বিশ্বজনীন করে গড়ে তােলা হয়। নতুন প্রবর্তিত আইনগুলাের সূত্রগুলাে হলাে— পরিবর্তিত সামাজিক রীতিনীতি, দার্শনিক জেনাের শিষ্যদের আদর্শ, বিচারকদের সিদ্ধান্ত এবং মূলত প্রিটরদের আদেশ। প্রিটররা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। আইনকে তারা একটি বিশেষ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে জুরীদের যে-কোনাে মামলা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দিতেন। জুরীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করলেও মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়ার ক্ষমতা ছিল প্রিটরদেরই। প্রিটরদের আইনের ব্যাখ্যাগুলাে পরবর্তীকালে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেকখানি সাহায্য প্রদান করেছিল। এভাবে রােমানরা এমন একটি আইন ব্যবস্থা গড়ে তােলে যা আধুনিক রােমীয় আইনের ভিত্তি হিসেবে কার্যকরী হয়। 

প্রিটরদের সহযােগিতায় রােমান আইনের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে। সম্রাট অগাস্টাস, জাস্টিনিয়ন, জুলিয়াস সিজার এবং তার উত্তরাধিকারিগণ ক’জন বিশিষ্ট জুরীকে মামলার নিষ্পত্তির বিষয়ে চূড়ান্ত অভিমত ব্যক্ত করার অধিকার দান করেন। বিভিন্ন সময়ে পওলাস, পেপিনিয়ান, পেইটাস এবং উলপায়েনকে এ অধিকার দেয়া হয়। এরা সবাই আইনশাস্ত্রবিদ ছিলেন এবং এরাই রােমান আইনের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ভিত্তি রচনা করেন। এরূপে প্রণীত রােমান আইন জাস সিভিলে [Jus civile), জাস জেন্টিয়াম [Jus gentium] এবং জাস নেচারেলে [Jus naturale) এ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাস সিভিলে রােমান নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য ছিল। এ আইন কখনাে ছিল লিখিত বা কখনাে ছিল অলিখিত। এর মধ্যে সিনেটের বিধানসমূহ, প্রিন্সিপ্টদের নির্দেশসমূহ, প্রিটরদের আদেশসমূহ এবং প্রচলিত রীতিনীতি সাধারণ আইনরূপে স্বীকৃত ছিল। জাস জেন্টিয়াম জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল রােমান নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য ছিল। এ আইনের বলে দাসপ্রথাকে স্বীকৃতি প্রদান, ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, ক্রয়বিক্রয়ের নীতি নির্ধারণ, অংশীদারিত্ব ও চুক্তির কার্যক্রম প্রভৃতি সম্পাদিত হতাে। এ আইন সাধারণ বিদেশিদের বিচারকার্য সম্পন্ন করার সময় সিভিল আইনকে প্রায়শ সাহায্য করতাে। জাস নেচারেলে (প্রাকৃতিক আইন) ছিল রােমান আইনের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিক। এ আইনে বিবৃত হয়েছে যে, মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে সমান অধিকারপ্রাপ্ত এবং কোনাে সরকারের অধিকার নেই এর উপর হস্তক্ষেপ করার। এ আইনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা সিসেরাের মতে- প্রাকৃতিক আইনই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। যে শাসক আইনকে অস্বীকার করে সে নিঃসন্দেহে অত্যাচারী। পরবর্তীকালের প্রায় সকল আইন প্রবক্তা এর সপক্ষে মত দিয়েছেন এবং সকল নাগরিক আইন প্রণয়নের সময় জাস নেচারেলে বা প্রাকৃতিক আইনের সাথে সঙ্গতি রেখে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। 

রােমান আইন, বিশেষ করে ধনীদের সম্পত্তি রক্ষা সম্পর্কিত আইন, আধুনিককালে ইউরােপ ও আমেরিকার এবং সে সূত্রে সমগ্র ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার আইন ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে নানা আকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 

এক কথায় বলা যায় যে, রােমান আইনের প্রভাব বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সকল দেশের আইন ব্যবস্থার উপর বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। ঐতিহাসিক জে. ই. সওইন বলেন, "রােমান আইনে জনগণের সার্বভৌমত্বের যে ধারণ পরিদৃষ্ট হয়, তা পরবর্তীকালে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে একটি শক্তিশালী অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।” 


কৃষি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য 

রােমে কৃষিভূমির মালিক ছিলেন ধনী ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা। মধ্যবিত্ত কিংবা গরিব- জনগণ কৃষি ভূমির মালিকানা প্রাপ্ত হলেও তারা তাদের ভূমি অধিককাল নিজেদের ভােগ দখলে রাখতে সক্ষম হতো না। ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রােমের পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ পূর্বাঞ্চলের জনগণ অপেক্ষা অধিক সজাগ ছিল। ইতালির ব্যবসায়ীরা মদ, জলপাই-এর তেল, তক্তা , ধাতুজ পদার্থ ইত্যাদি রপ্তানি করতাে এবং অপরপক্ষে মূল্যবান পাথর তুলা, মণিমুক্তা, মসলা , ক্ষৌমবস্ত্র (Silk cloth), কাচের বাসনপত্র , প্রসাধন দ্রব্য ইত্যাদি আমদানি করতাে। দেশে ব্যাংক ব্যবস্থা অপ্রতুল ছিল।


চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্য  

স্থলভাগের দৃশ্যের চিত্রাঙ্কনে, গীর্জার দেয়াল চিত্রাঙ্কনে, বাইবেলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণে কিংবা সাধু পুরুষদের জীবনবৃত্তান্ত সম্বলিত পুস্তকাবলি অলংকরণে রােমানরা সিদ্ধহস্ত ছিল। তারা জনৈক রােমান যুবকের মস্তক নির্মাণে যে ভাস্কর্য কৌশল প্রদর্শন করেছে তা অতুলনীয়। তাদের অনুরূপ খােদাই করা আরও কয়েকটি ভাস্কর্যের নির্দশন লক্ষ করা যায়। তারা সুন্দর সুন্দর গীর্জা, থিয়েটার, স্নানাগার, গৃহ প্রভৃতি নির্মাণ করে স্থাপত্য শিল্পে তাদের নিপুণতা প্রদর্শন করেছে। 


দর্শন, সাহিত্য ও শিক্ষা

দার্শনিক ক্যাটো (খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪–১৪৯ অব্দ) যিনি পাশ্চাত্যের সক্রেটিস নামে অভিহিত হতেন , তিনি দর্শনের ক্ষেত্রে গ্রিকদের অবদান অস্বীকার করেন। সক্রেটিসের ন্যায় তিনিও যুক্তি, শিক্ষা ও নৈতিক নিয়মানুবর্তিতার সমর্থক ছিলেন। সিসারাে, এনটোনিনাস, লুক্রেটিয়ান প্রমুখ ছিলেন রােমের বিখ্যাত দার্শনিক।

রােমানদের শাসনামলে ল্যাটিন ভাষা উন্নতির চরম শীর্ষে আরােহণ করে। অধিকাংশ সভ্য জগতে এ সময় ল্যাটিন ভাষা প্রচলিত ছিল। স্বয়ং সম্রাট জুলিয়াস সিজার , লিভি, টেসিটাস প্রমুখ ছিলেন প্রখ্যাত রােমীয় ঐতিহাসিক। শিক্ষা-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রােমানরা সম্পূর্ণভাবে গ্রিক পণ্ডিতদের উপর নির্ভরশীল ছিল। স্কুলে সাধারণত ব্যাকরণ, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যামিতি , জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্থাপত্য ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা হতাে। সম্রাট হাড্রিয়ান সর্বপ্রথম একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।


বিজ্ঞানে রোমানদের অবদান

প্লিনি ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি প্রাকৃতিক ইতিহাস রচনা করেন। টলেমী ছিলেন অপর একজন বিজ্ঞানী যিনি ত্রিকোণমিতি সম্পর্কে পণ্ডিত ছিলেন। তার মতে পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট চক্র রয়েছে। রােমান বিজ্ঞানিগণ সৌর বছরকে ৩৬৫ দিনে গণনা করে প্রতি চার বছর অন্তর আরও ১ দিন যােগ করেন। রােমান সম্রাটদের শাসনামলে প্রত্যেক গ্রাম, নগর, শহর ও বন্দরে বেতনভুক্ত চিকিৎসাবিদ নিযুক্ত করে জনসাধারণের সুস্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা করা হতাে। গ্যালেন ছিলেন সে যুগের একজন ইতিহাস প্রসিদ্ধ চিকিৎসাবিদ। প্রকৌশল বিদ্যায় রােমানরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। 


রোমানদের ধর্ম বিশ্বাস

বেথেলহাম শহরে সম্রাট অগাস্টাসের রাজত্বকালে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশু (ঈশা আ.) জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে স্বয়ং তিনি ও তাঁর পূর্বপুরুষগণ ইহুদি ধর্মাবলম্বী হলেও যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীতে এক নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। হিব্র “জসুয়া” শব্দ হতে “জেসাস” শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে। যেহেতু তিনি সমগ্র বিশ্বের অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষকে উদ্ধার করার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন, সেজন্য তাকে “ক্রাইস্ট” বা ত্রাণকর্তা উপাধি দেয়া হয়েছিল। যিশু ছিলেন ভালােবাসা, ক্ষমা ও শান্তির দূত। তিনি ঐশী দয়া ও প্রেম প্রচার করেছিলেন। ৩০ বছর বয়সে যিশুখ্রিস্ট মাত্র ১৮ মাস জনসাধারণের কাছে তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। সম্রাট তাহবেরিয়ান তাঁকে সিরিয়ার এ্যান্টিয়ক শহরে কুশবিদ্ধ করে হত্যা করেন। পরবর্তীকালে সেন্ট পলের অক্লান্ত চেষ্টায় এ ধর্ম এশিয়া মাইনর, গ্রিস, রােম ও ইউরােপে বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে প্রায় সমগ্র আমেরিকা ও ইউরােপ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। 

পরবর্তীকালে খ্রিস্টান জগৎ যিশুকে রাজা ডেভিডের বংশধর এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে প্রচার করেছিলেন। খ্রিস্টানগণ এক খােদার পরিবর্তে তিন খােদাতে বা “ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী। তাদের মতে- আল্লাহ, মেরি (মরিয়ম আঃ) এবং যিশু (ঈশা আঃ) সমানভাবে শ্রেষ্ঠ ও পূজনীয়। তারা মরিয়ম (আ)-কে আল্লাহর স্ত্রী এবং ঈশা (আ)-কে আল্লাহর সন্তান মনে করে। রােমানগণ প্রায় সবাই খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্রাট কনসটানটাইন স্বয়ং খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে উক্ত ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দান করেন। ফলে রােমে খ্রিস্টান ধর্ম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। 


রোমান সভ্যতার মূল্যায়ন ও প্রভাব

ল্যাটিন ভাষা, রােমানদের রাজনৈতিক আদর্শ, আইন, সামরিক সংগঠন এবং প্রকৌশলবিদ্যা বিশ্বের ভাবী বংশধরদের জন্য ছিল অত্যন্ত মূল্যবান অবদান। তারাই সর্বপ্রথম একটি বিশ্ব-রাজ্য গঠনের পরিকল্পনার প্রবর্তক। জনগণের ইচ্ছাই যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের চালিকাশক্তি সে ধারণাও রােমানগণ পরবর্তী সভ্যজগতকে প্রদান করে। ঐতিহাসিক ও’লিয়ারীর মতে— “তাদের ইনসটিটিউট কোড” এবং “ডাইজেস্ট অব জাস্টিনিয়ন” মানব সংস্কৃতির উল্লেখযােগ্য সংযােজন। এক কথায়, রােমান সভ্যতার প্রভাব মুসলিম ও অমুসলিম এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল দেশ ও জাতির উপর বর্তমানকালেও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে গ্রিক ও রােমান সমাজ ও সভ্যতার উপর ভিত্তি করে এশিয়া মাইনরে বাইজান্টাইন সভ্যতা গড়ে ওঠে। এ সভ্যতা বিকাশে প্রাচ্য দেশীয় প্রভাবও লক্ষণীয়।


তথ্যসূত্র : 
বই : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
লেখক : হাসান আলী চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন