বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ - 7 March Speech of Bangabandhu

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ - 7 March Speech of Bangabandhu - Bongo Tweet
ছবি: albd.org

বাঙালির জাতীয় জীবনে ৭ই মার্চ একটি উল্লেখযােগ্য দিন। এ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দি উদ্যান) লক্ষ জনতার সমাবেশে এক ঐতিহাসিক ও দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দেন। ইতিহাসে এটা ৭ই মার্চের ভাষণ হিসেবে পরিচিত।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। নিয়ম অনুযায়ী আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু শুরু হয় বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা না দেয়ার তৎপরতা। জুলফিকার আলী ভূট্টো পাকিস্তানে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল (আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি) তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে নেমে আসে। ইয়াহিয়া খানের এই ঘােষণার প্রতিবাদে ২রা ও ৩রা মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। চারদিকে শ্লোগান ধ্বনিত হতে থাকে বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ও স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন ইতিহাসে এটা ৭ই মার্চের ভাষণ নামে পরিচিত। তৎকালীন সময়ে শুধু পাকিস্তানের জনগণ নয় সারা বিশ্বের মানুষ ও নেতৃবৃন্দের উৎসুক দৃষ্টি ছিল এই ভাষণের উপর। তিনি জাতীয় পরিষদে যােগদানের শর্ত হিসেবে চারটি দাবি উত্থাপন করেন। 

  • সামরিক আইন প্রত্যাহার, 
  • সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে,
  • সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে হবে,
  • নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। 

শেখ মুজিব জনগণকে পূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। মাত্র ১৮ মিনিটের এক বক্তৃতায় তিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শােষণের ইতিহাস তুলে ধরেন। তিনি অসহযােগ আন্দোলনের পটভূমি ও কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। পাশাপাশি তিনি জনগণকে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এই ভাষণটি আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।



বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বােঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভােট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমরি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে এবং এদেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবাে। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস— এই রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষ মানুষের করুণ আর্তনাদ এদেশের করুণ ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। 

১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খী মার্শাল ল' জারি করে ১০ বছর আমাদের গােলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খার পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন- আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলাে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরােধ করেছিলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দিতে। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে সভা হবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেমব্লিতে বসবাে। আমি বললাম, এসেমব্লির মধ্যে আলােচনা করবাে- এমনকি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতেও যদি তা ন্যায্য কথা হয়, আমরা মেনে নেব। 

ভুট্টো সাহেব এখানে ঢাকায় এসেছিলেন, আলােচনা করলেন। বলে গেলেন আলােচনার দরজা বন্ধ নয়, আরও আলােচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলােচনা করলাম— আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে— সবাই আসুন বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেঘর যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমরি। তিনি বললেন, যে যে যাবে তাদের মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে পেশােয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেমরি চলবে। আর হঠাৎ ১ তারিখ এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলাে। 

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবাে। ভুট্টো বললেন, যাবেন । ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলাে, দোষ দেওয়া হলাে বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হলাে আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। 

আমি বললাম, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাে, সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাে। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অত্র আমার দেশের গরীব-দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। 

আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরীবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কীভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে রাউন্ডটেবিল কনফারেন্স ডাকব। 

আমি বলেছি, কীসের এসেমরি বসবে; কার সঙ্গে কথা বলব? আপনারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলব? পাঁচ ঘণ্টার গােপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমাদের উপর , বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন। দায়ী আমরা।

২৫ তারিখ এসেমব্লি ডেকেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া দিয়ে, শহিদের উপর পাড়া দিয়ে, এসেমরি খােলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল ল' withdraw করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লােকদের ব্যারাকের ভেতর ঢুকতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তাদের তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবাে আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবাে কী পারবাে না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে আমরা বসতে পারি না। 

আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট-কাছারী, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলি আছে, সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুরগাড়ি, রেল চলবে শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনাে কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, এরপর যদি ১টি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয়— তােমাদের কাছে অনুরােধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তােমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবাে, আমরা পানিতে মারবাে। সৈন্যরা! তােমরা আমার ভাই, তােমরা ব্যারাকে থাকো, তােমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তােমরা গুলি করার চেষ্টা করাে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। 

আর যে সমস্ত লােক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্র পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করবাে। যারা পারেন আওয়ামী লীগ অফিসে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর ৭ দিন হরতালে। শ্রমিক ভাইয়েরা যােগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন ওয়াপদা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলাে— কেউ দেবে না। শুনুন , মনে রাখুন শত্ৰু পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালি, অ-বাঙালি তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শােনে তাহলে কোনাে বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খােলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনেপত্র নিতে পারবে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানাে চলবে। 

এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দেবাে। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে তুলবাে ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। 

তথ্যসূত্র : 
বই : পৌরনীতি ও সুশাসন। 
লেখক : প্রফেসর মোঃ মোজাম্মেল হক

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন