সংক্ষেপে খেলাফত ও গনতন্ত্রের মৌলিক কিছু পার্থক্য

সংক্ষেপে খেলাফত ও গনতন্ত্রের মৌলিক কিছু পার্থক্য - Bongo Tweet

১ - উদ্ভবের সময়কাল ও প্রেক্ষাপটের পার্থক্য: খেলাফত গনতন্ত্র না এবং গনতন্ত্র কখনোই খেলাফত না। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দুটোই স্বতন্ত্র পদ্ধতি। দুটোর উৎপত্তির সময়কাল, স্থান ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। খেলাফত এসেছে আরবের বিশ্বাসী মুসলমানদের হাত ধরে অধর্ম প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে ষষ্ঠ শতকে। গনতন্ত্র এসেছে ধর্ম প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে ইয়োরোপের অবিশ্বাসীদের হাত ধরে রেনেসাঁ যুগে।

২ - শাসক নির্বাচনে প্রক্রিয়াগত পার্থক্য: খলিফা নির্বাচনের জন্য গনভোট বিধেয় না। খলিফা নির্বাচিত হয় মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, শিক্ষিত, আল্লাহভিরু, ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ ও মনোনয়নের ভিত্তিতে। আর গনতন্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাসক আসেন গনভোটের ভিত্তিতে। বুঝমান ও অবুঝের মতামত এখানে এক পাল্লায় মাপা হয় যা যুক্তির নিরিখে মানোত্তীর্ণ হওয়া অসম্ভব।

৩ - কাঠামোগত পার্থক্য: খিলাফাহ এর রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো ও পদ্ধতি কোরআন হাদিস নির্ভর হওয়া আবশ্যক। এখানে কোন বিরোধী দল নেই। ফলে জনগণের মাঝে ক্ষমতার কোন্দলের সুযোগ নেই। সর্বসম্মতভাবে খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আমৃত্যু বহাল থাকেন। (যদি তিনি ইসলামের পথে একনিষ্ঠ থাকেন) গনতান্ত্রিক শাসনে স্রষ্টার আনুগত্যের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। জনগন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতেই এর কাঠামো ও শাসন পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। বিরোধীদল গনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। ক্ষমতার কোন্দল গনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান নিয়ামক।

৪ - বিশ্বাসগত পার্থক্য: খেলাফতে সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার। গনতন্ত্রে জনগন ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সর্বময় কর্তৃত্বের দাবীদার।

৫ - মানবাধিকার রক্ষায় প্রায়োগিক পার্থক্য: খেলাফত সবসময়ই ইসলাম নির্ভর। ধর্মনিরপেক্ষ না। স্রষ্টার পাঠানো জীবনবিধান ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুসারেই খেলাফতের অধীনে অন্যান্য ধর্মের অনুসারী প্রাপ্য অধিকার পুর্ণরুপে নিশ্চিত করা হয়। পক্ষান্তরে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনগতভাবে ধর্মকে মুছে ফেলা সম্ভব। অর্থাত স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি এখানে মূখ্য।

৬ - উৎসগত পার্থক্য: খেলাফত আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দশনা মোতাবেক সৃষ্ট। অর্থাৎ এর মূল কাঠামোগত দিকনির্দেশনা ঐশী সূত্রে প্রাপ্ত। আর গনতন্ত্র পশ্চিমের স্রষ্টাবিমুখ অমুসলিম সমাজের চিন্তকদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, রুচি ও বোধবুদ্ধির আলোকে সৃষ্ট। উৎসগত পার্থক্যটা অনেকাংশেই স্রষ্টামুখিতা ও সৃষ্টিমুখিতার।

৭ - উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: খেলাফত সর্বোতভাবেই ধর্মাশ্রিত শাসনকাঠামো। সমাজকে সর্বোত্তম ধর্মব্যবস্থার অধীনে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যেই খেলাফতের উদ্ভব। আর গনতন্ত্রের জন্মই হয়েছে ধর্মমুক্ত স্বতন্ত্র শাসনব্যাবস্থা হিসেবে। ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রেখে স্রষ্টার পাঠানো ধর্মের শৃঙ্খলমুক্ত, স্বেচ্ছাচারী ও আদিকাল থেকে চর্চিত নৈতিকতার অর্গলবিহীন লিবারেল জীবনের চর্চার জন্যই ডেমোক্রেসির উদ্ভব।

এছাড়া আরো অনেক পার্থক্য দেখানো সম্ভব। তবে আমরা মনে করি যে, চিন্তাশীলদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। শুধুমাত্র ইতিহাস ও বাস্তবতা সামন থাকলেও গনতন্ত্রকে ইসলামী খেলাফতের সমার্থক দাবী করাটা অসম্ভব। দুটো স্বতন্ত্র ব্যবস্থাকে এক করে দেখার প্রবনতা সামগ্রিকভাবে জ্ঞানগত বৈকল্যের প্রমান।

মোটকথা, খেলাফতকে আপাদমস্তক ধর্মাশ্রিত একটা শাসনকাঠামো হিসেবে মূল্যায়ন করা উচিত। তেমনিভাবে গনতন্ত্রকে মূল্যায়ন করা উচিত পশ্চিমের ধর্মমুক্ত, স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও উত্তরাধুনিক একটি শাসনকাঠামো হিসেবে। কেউ যদি গনতন্ত্রের ধর্মায়ন বা ধর্মের গনতন্ত্রায়ন করতে চায় তাহলে সেটা একই সাথে ধর্ম ও গনতন্ত্র উভয়ের অবমাননা। দেশের বোদ্ধামহলের কাছে সমন্বয়ের নামে এ ধরনের বিকৃতি গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। আমরা চাই যে যেটাকেই গ্রহণ করুক না কেন সে যেন তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। নিজের আদর্শের সাথে যেন সৎ হয়। এতে করে অন্তত পরিচয়কেন্দ্রিক ধোঁয়াশা বা গোলকধাঁধাঁ তৈরী হয়না।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন