জিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলত

জিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলত - Bongo Tweet - বঙ্গ টুইট


জিকিরের পরিচিতি

জিকির অর্থ স্মরণ করা, মনে রাখা, বর্ণনা করা বা মেনে চলা। জিকির যখন নীরবে সম্পন্ন হয় তখন তার অর্থ হয়- স্মরণ করা। সরবে জিকির হালে তার অর্থ দাঁড়ায়- বর্ণনা করা। যিনি জিকির করেন তাকে বলে 'জাকির'। অভ্যাসগতভাবে যিনি জিকির করেন বা জিকিরকে যিনি অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছেন তাকে 'মুযাক্কির' বলে। 

ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, সার্বক্ষণিক আল্লাহকে স্মরণে রাখা, তাঁর প্রশংসা করা ও তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করাকে জিকির বলে।

সুফি সাধকগণের মতে, জিকির হলাে সবরকম কাজকর্মে, আচার-আচরণে মুখে আল্লাহর নাম উচ্চারণ ও অন্তরে স্মরণের মাধ্যমে তাঁর সাথে মানুষের আত্মার মিলন ঘটানাের পদ্ধতি।

ইমাম কুরতুবী (র)-এর মতে, জীবনের সবক্ষেত্র ও পর্যায়ে আল্লাহর বিধিনিষেধের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শনের নাম জিকির।

জিকিরের প্রকারভেদ

জিকিরের ধরন, পদ্ধতি ও প্রকৃতি বিবেচনায় প্রথমত জিকিরকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। এগুলাে হলাে - জিকিরে কালবি বা অন্তরের জিকির এবং জিকিরে লিসানি বা মৌখিক জিকির।

জিকিরে কালবি : অন্তরে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করাকে "জিকিরে কালবি' বা অন্তরের জিকির বলে। মুমিনের কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, লেন-দেন, চরিত্র-বিশ্বাস ও কথাবার্তায় জিকিরে কালবির প্রকাশ ঘটে। সেজন্য পৃথিবীতে প্রতিটা মুহূর্তে, প্রত্যেক কাজে আল্লাহর নির্দেশের অনুশীলনকেও জিকিরে কালবি বলা যায়। জিকিরে কালবির নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন - "আর তুমি তােমার প্রভুর জিকির কর ক্রন্দনরত ও ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়, মনে মনে (সুরা আরাফ: ২০৫)।"

জিকিরে লিসানি : লিসান বা জিহ্বার মাধ্যমে আল্লাহর নাম উচ্চারণ, কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন এবং আল্লাহ তায়ালা ও রাসুলুল্লাহ (স) সম্পর্কে আলােচনার মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করার নাম 'জিকিরে লিসানি বা মৌখিক জিকির। জিকিরে লিসানি দু'রকম হতে পারে। যথা- 

(ক) জিকিরে জলি বা উচ্চকণ্ঠে জিকির। তবে এত বেশি উচ্চকণ্ঠে নয় যা চিতকারের পর্যায়ে পৌছে। আল্লাহ বলেন - "এমন স্বরে জিকির কর যা চিৎকার করা অপেক্ষা কম (সুরা আল-আরাফ: ২০৫)।"

(খ) জিকিরে খফি বা নিঃশব্দে জিকির। এ জিকিরেও জিহ্বা ব্যবহৃত হয়। তবে কোনাে শব্দ করা ছাড়াই এতে আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন নাম উচ্চারণ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন - "তােমার জিহ্বা যেন সবসময় আল্লাহ তায়ালার জিকিরে সিত্ত থাকে (জামিউত তিরমিযি)।"

জিকিরের উল্লিখিত প্রকার দুটো ছাড়াও সুফি-সাধকগণ এর আরাে তিনটি প্রকারের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা-

জিকিরে আনফাসি: শ্বাস-প্রশ্নাস গ্রহণ ও বর্জনের সাথে আল্লাহর জিকিরের নাম 'জিকিরে আনফাসি' বা শ্বাস-প্রশ্বাসের জিকির। এ জিকিরে মুমিনের অন্তরে একটা বিশেষ চেতনা কাজ করে।

জিকিরে আয়নি: চোখ বা দৃষ্টিশক্তির সংকোচন ও প্রক্ষেপণের মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের উপলব্ধি হলাে 'জিকিরে আয়নি' বা চোখের জিকির।

জিকিরে দায়িমা: ব্যক্তি যখন শব্দে বা নিঃশব্দে, মুখে মুখে বা মনে মনে, চোখের প্রতিটা প্রক্ষেপণ ও সংকোচনে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ ও বর্জনে আল্লাহর জিকিরে লিপ্ত হয় তখন তাকে 'জিকিরে দায়িমা' বা সার্বক্ষণিক জিকির বলে।

আরও পড়ুনঃ

জিকিরের স্তর

জিকিরের যেমন বিভিন্ন প্রকার রয়েছে তেমনি জিকির করারও নানারকম পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতিগুলাে হলাে জিকিরের পর্যায়ক্রমিক সােপান বা স্তর। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাযযালি (র) সার্বিক বিবেচনায় জিকিরের চারটি স্তর নিরূপণ করেছেন। এ স্তরগুলাে হলাে-

প্রথম স্তর - মৌখিক জিকির: প্রথম স্তরের জিকির হলাে শুধু মুখে মুখে শব্দে বা নিঃশব্দে আল্লাহর নাম বা বিশেষ বিশেষ বাণী উচ্চারণ করা। এর সাথে হৃদয়ের কোনাে সম্পর্ক থাকে না। নিজেকে অপ্রয়ােজনীয় ও অশালীন কথাবার্তা থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে মৌখিক জিকির কার্যকর। এর মাধ্যমে গিবত করা ও মিথ্যা বলার অভ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

দ্বিতীয় স্তর - অন্তরের একাগ্রতাহীন জিকির: এ স্তরের জিকির মুখে মুখে সম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি ব্যক্তির অন্তরও স্পর্শ করে। কিন্তু নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা তেমন প্রবল থাকে না। একাগ্রতা না থাকার কারণে দ্বিতীয় স্তরের জিকিরকারী প্রায়ই গাফিল হয়ে পড়ে।

তৃতীয় স্তর - অন্তরের একাগ্রতাপূর্ণ জিকির: জিকিরের তৃতীয় স্তরে ব্যক্তির একাগ্রতা ও নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তি মৌখিকভাবে আল্লাহর যে নাম, গুণ ও নির্দেশের জিকির করে, সাথে সাথে তার অন্তর সে নাম, গুণ ও নির্দেশের দাবি পূরণে প্রস্তুত হয়ে যায়। ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহর জিকির স্থায়ীভাবে বদ্ধমূল হয়।

চতুর্থ স্তর - আল্লাহর প্রেমে তন্ময়পূর্ণ জিকির: জিকিরের চতুর্থ স্তর হলাে পরম ও চূড়ান্ত স্তর। এ স্তরে জিকিরকারীর অন্তরের নিষ্ঠা, একাগ্রতা, আন্তরিকতা ও নিবিড় অনুশীলন পূর্ণতা লাভ করে। তার মধ্যে আল্লাহভীতি এবং আল্লাহপ্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে আল্লাহর জিকির অব্যাহত রেখে জিকিরকারী জিকিরের পরম স্তরে উপনীত হতে পারে।

ব্যক্তিজীবনে জিকিরের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা

আল্লাহর নির্দেশ পালন : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর জিকির করার জন্য মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআনে - "হে মুমিনগণ! তােমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘােষণা কর (সুরা আল আহযাব: ৪১-৪২)।

মানসিক প্রশান্তি লাভ : জিকিরের মাধ্যমে ব্যক্তি সবসময় নিজের কাছে আল্পাহর উপস্থিতি অনুভব করে। আল্লাহর ক্ষমতা ও রহমতের ব্যাপারে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- "জেনে রাখ, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয় (সুরা রাদ: ২৮)।"

আল্লাহর সাথে যােগাযােগ স্থাপন : জিকিরের মাধ্যমে মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে, সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালাও তার প্রত্যুত্তর দেন। আল্লাহ বলেন - "তােমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তােমাদের স্মরণ করব, আর আমার শােকর আদায় কর এবং কুফরি কর না (সুরা আল-বাকারা: ১৫২)।

শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা : শয়তানের মূল কাজই হচ্ছে মানুষকে পাপকাজের কুমন্ত্রণা দেওয়া। জিকিরের মাধ্যমে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।

অন্তর শুদ্ধকরণ : হাদিসে এসেছে একটি পাপ করলে মানুষের অন্তরে একটি করে কালাে দাগ পড়ে। ব্যক্তি অব্যাহতভাবে পাপ করতে করতে তার অন্তর কালাে দাগে ভরে যায়। আল্লাহর জিকির মানুষকে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারে।

পার্থিব ও পরকালীন ক্ষতি প্রতিরােধ : আল্লাহর জিকির মানুষকে আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত করে। তার পৃথিবী ও পরকালের জীবন আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি মুক্ত হয়। আল্লাহ বলেন- "হে মুমিনগণ! তােমাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি যেন তােমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত না রাখে। যারা আল্লাহর জিকির থেকে এরপ বিরত থাকবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত' (সুরা মুনাফিকুন: ৯)।

শ্রেষ্ঠতম ইবাদত : আল্লাহর জিকির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স) সাহাবিদের এক সমাবেশে বলেন, "আমি কি তােমাদের এমন আমলের সন্ধান দেব না, যা অন্যান্য আমল থেকে উত্তম? যা আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, তােমাদের মর্যাদা সমুন্নতকারী, আল্লাহর পথে সােনা-রুপা দানের চেয়ে এবং সে জিহাদ থেকেও উত্তম। সে আমল হলাে আল্লাহর জিকির।"

অন্তরে সারল্য ও আল্লাহর রহমত লাভ : রাসুলুল্লাহ (স) বলেন - "আল্লাহর জিকির ছাড়া অন্য কথা বেশি বেশি বল না। কেননা অন্য কথা অন্তর কঠিন করে দেয়। আর নিশ্চয়ই কঠিন হৃদয়ের মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে থাকে (জামিউত তিরমিযি)।

ক্ষমা ও উত্তম প্রতিদান লাভ : আল্লাহর জিকিরে ব্যক্তি শুধু সওয়াবপ্রাপ্ত হয় না বরং বিভিন্ন গুনাহ থেকে ক্ষমাও লাভ করে। আল্লাহর নিষ্ঠাপূর্ণ জিকির মানুষকে উত্তম প্রতিদানের নিশ্চয়তা দেয়।

সমাজজীবনে জিকিরের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা

জিকির ব্যক্তিগত ইবাদত হলেও সমাজজীবনে এর গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কেননা ব্যক্তি স্বতন্ত্র কোনাে সত্তা নয়। সে সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ব্যক্তিগতভাবে জিকিরের মাধ্যমে মানুষ নিজে যখন পরিশীলিত, সুন্দর ও প্রশান্ত হয়ে ওঠে তখন সামাজিকভাবে শালীনতা, সৌন্দর্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে পবিত্র সমাজ, পরিচ্ছন্ন সামাজিক জীবন ও সুশৃঙ্খল সামাজিকতা প্রতিষ্ঠায় জিকির বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা জিকিরে যখন মুমিন শৃঙ্খলাবদ্ধ হন তখন সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। আল্লাহর জিকির মানুষকে অন্যায়, পাপাচার ও অপরাধমুক্ত রাখে বলে সমাজও অপরাধমুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সর্বোপরি আল্লাহর নির্দেশের অনুবতী হয়ে জিকিরের মাধ্যমে ব্যক্তি তার ওপর অর্পিত সামাজিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। ফলে পারস্পরিক সহাবস্থান সৌহার্দ্যপূর্ণ, সহযােগিতামূলক ও সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে ওঠে।

মন্তব্য করুন

নবীনতর পূর্বতন