মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির যথাযথ উন্মেষ ও বিকাশে মুসলিম জাতির অবদান অবিস্মরণীয়। ইসলাম জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা গ্রহণকে ফরজ করে দিয়ে শিক্ষা ও জ্ঞাননির্ভর যে ধারার সূচনা করেছে তারই ধারাবাহিকতায় মুসলিম মনীষীরা গবেষণায় আত্মনিয়ােগ করেছেন। তাঁদের অনুসন্ধিৎসা ও গবেষণা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করেছে। যে জন্য আধুনিক বিজ্ঞান কেবল চমকপ্রদ আবিষ্কার ও কালােত্তীর্ণ তত্ত্বের জন্যই মুসলিমদের কাছে ঋণী নয়,বরং আজকের এই অত্যাআধুনিক বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের জন্যও মুসলিম মনীষীদের কাছে চিরঋণী।
শিক্ষা ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ভূমিকা
বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (স) অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন না হলেও তিনি ছিলেন মহাজ্ঞানী। তিনি কারাে কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কোনাে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তাঁর একমাত্র শিক্ষক হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। ওহি পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রাসুল (স) কে সব বিষয়ের জ্ঞানদান করেছেন। সে জন্য রাসুলুল্লাহ (স) শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। নবুয়ত লাভের তিন বছরের মধ্যেই তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা নেন। এ সময়ে মক্কার পরিবেশ পুরােপুরি ইসলামের বিরুদ্ধে ছিল। মুসলিমদের কোনাে রকমের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। এই সময় সাধারণত গরিব শ্রেণির লােকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তাই মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালাে ছিল না।
চারিদিকে এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এরকম একটি বৈরী পরিবেশে রাসুলুল্লাহ (স) 'দারুল আরকাম' নামে একটি মাদ্রাসা বানান। পবিত্র মক্কা নগরীর সাফা পাহাড়ের উপরে হযরত আরকাম (রা) এর বাড়ির মধ্যে মাদ্রাসাটি বানান। দারুল আরকামের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাসুল (স)। তিনি সেখানে মুসলিমদের প্রয়ােজনীয় হুকুম-আহকাম শেখাতেন। রাসুলুল্লাহ (স)-এর নিজের বাসগৃহটিও বিদ্যালয়ের রূপ লাভ করেছিল। সবার জন্য এবং সবসময় এ বাড়ির দরজা উন্মুক্ত ছিল। প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর সাথে উম্মুল মুমিনীনগণও শিক্ষাদানে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। যে জন্য রাসুলের (স) ইন্তেকালের পর হযরত আয়েশা, হাফসা, উম্মে সালমা প্রমুখ নবিপত্নীর উদ্যোগে নবিজীর ঘর নারীদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
বদর যুদ্ধে বন্দি মুশরিকদের মুক্তিপণ হিসেবে রাসুলুল্লাহ (স) শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে একটি অভিনব উদ্যোগ নেন। তিনি প্রতিজন শিক্ষিত বন্দিকে তিনজন মুসলমানকে জ্ঞানদান করার শর্তে মুক্তি দেন। মসজিদে নববির নির্মাণ কাজ শেষ হলে শিক্ষাবিস্তারে রাসুলুল্লাহ (স) অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। তিনি মসজিদের বারান্দায় একটি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অবস্থান করে নবিজীর (সা) থেকে জ্ঞান অর্জনে আত্মনিয়ােগ করতেন। এ বিদ্যালয়টি 'সুফফা' এবং এর শিক্ষার্থীরা 'আহলি সুফফা' নামে পরিচিত। মসজিদে নববিতে মহানবি (স) নিজে বিভিন্ন শিক্ষার আসর পরিচালনা করতেন। হযরত মুহাম্মাদ (স) শিক্ষাগ্রহণ করতে এবং শিক্ষাপ্রদান করতে ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। এর ফলে মহানবি (স) একটি অশিক্ষিত জাতিকে পৃথীবির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিত জাতিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
শিক্ষা ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদার ভূমিকা
হযরত মুহাম্মাদ (স) এর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার বুনিয়াদ খােলাফায়ে রাশেদার আমলে ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করে। খােলাফায়ে রাশেদার চার সদস্য যথাক্রমে হযরত আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা) ও আলী (রা) শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। তাদের সবাই মসজিদে নববিকে প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। পাশাপাশি খিলাফতের অধীন সব মসজিদকে শিক্ষালয়ে পরিণত করেন।
হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফতকালে পবিত্র কুরআন মাজিদের গ্রন্থাবদ্ধ সংকলন সম্পন্ন হয়। হযরত উসমান (রা) কুরআন শরিফ গ্রন্থাবদ্ধ সংকলন এর পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, যা শিক্ষাবিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
হযরত উমর (রা) প্রথম শিক্ষাবিস্তারের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা প্রবর্তন করেন । তিনি খিলাফতের বিভিন্ন এলাকায় মক্তব ও আনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানে বায়তুল মাল থেকে বেতনভুক্ত শিক্ষক নিয়ােগ করেন। যাযাবর বেদুইনদের শিক্ষিত করার জন্যও হযরত ওমর (রা) শিক্ষক নিয়ােগ করেন এবং কোন ব্যক্তি কমপক্ষে কুরআন তিলাওয়াত করতে না পারলে তার জন্য শাস্তির বিধান প্রবর্তন করেন।
হযরত উসমান ও আলী (রা) এ ব্যবস্থার প্রভৃত উন্নতি সাধন করেন। আলী (রা) তার অসামান্য পাণ্ডিত্যের জন্য রাসুল (স) এর কাছ থেকে 'জ্ঞানের দ্বার' উপাধি লাভ করেন। তাঁদের সদিচ্ছায় মুসলিম খিলাফতে শিক্ষাদান ও গ্রহণে বিপুল গতি সঞ্চার হয়।
আরও পড়ুনঃ
শিক্ষাবিস্তারে উমাইয়া খলিফাদের ভূমিকা
শিক্ষাবিস্তারে উমাইয়া খলিফাদের ভূমিকাও কম নয়। উমাইয়া খলিফা উমর বিন আব্দুল আযীয রাষ্টরীয়ভাবে হাদিস সংকলনের উদ্যোগ নেন। এ সময়ে দামেস্ক, কুফা, বসরা, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি অঞ্চলে কুরআন-হাদিসের অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সরকারি পৃষ্ঠপােষকতার মাধ্যমে জ্ঞান এবং বিজ্ঞান চর্চার বেশ কিছু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানও গড়েে উঠেছিল।
উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় হাকাম ৭৯৮ খ্রিটাব্দে স্পেনের রাজধানী কর্ডোভাতে প্রতিষ্ঠা করেন 'কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়'। আজও পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক অবদান রাখছে। উমাইয়া খলিফাদের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ পৃষ্ঠপােষকতায় মুসলিম মনীষীদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগােল, চিকিৎসা, গণিত, নৌচালনা প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রীয়জ্ঞান আলােচনার সূত্রপাত হয়। এ সময়ে ইসলামি ফিকহশাস্ত্র এর ওপর বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ধারার কাজ শুরু করা হয় যা পরে সুসংঘবদ্ধ রূপলাভ করেছিল।
শিক্ষাবিস্তারে আব্বাসীয় খলিফাদের ভূমিকা
আব্বাসীয় খলিফাগণ রাজ্য জয়ের চেয়ে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা বিস্তারে বেশি মনােযোগ দেন। ফলে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক অধ্যায় সূচিত হয়। আর মুসলিম জাতির শিক্ষাবিস্তারের স্বর্ণযুগ নির্মাতা হলাে আব্বাসীয় রাজবংশ। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর প্রথম শিক্ষাবিস্তারে খিলাফতকে সম্পৃক্ত করেন। তার সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্রিক ও সংস্কৃত পুস্তকের আরবি অনুবাদ শুরু হয়। পরবর্তী খলিফা হারুন অর রশীদ এ ধারার পূর্ণতা সাধন করেন।
এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য খলিফা আল মামুনের নাম। তিনি বাগদাদে *বায়তুল হিকমাহ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। এটি বিভিন্ন বিভাগে বিন্যস্ত ছিল। বায়তুল হিকমাহ গড়ে উঠেছিল পাঠাগার, গবেষণা, অনুবাদ, মানমন্দির ও শিক্ষাদান বিভাগ নিয়ে। এটি ছিল মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়।
আব্বাসীয় খলিফাগণ শিক্ষাবিস্তারের কাজ সুলভ ও সহজ করার জন্য বাগদাদে কাগজের কল স্থাপন করেন। তারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত অধ্যাপক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়ােগ করেন। সরকারি বেতনভুক্ত হলেও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তােলার জন্য আব্বাসীয় খলিফাগণই প্রথম মসজিদভিত্তিক পাঠাগার ব্যবস্থা গড় তােলেন। ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল শাসক হালাকু খান এর হাতে ধ্বংসের আগপর্যন্ত বাগদাদ ছিল শিক্ষাবিস্তার ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার রাজধানী।
ইউরােপে শিক্ষাবিস্তারে মুসলমানদের অবদান
৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের মাধ্যমে ইউরােপে ইসলামের প্রচার শুরু হয়। পরবর্তীতে এটিই সারা বিশ্বের শিক্ষা, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালি থেকে আগত শিক্ষার্থীরা কর্ডোভা, সেভিল, টলেডাে, জেইন ও মালাগার উচ্চশিক্ষায়তনগুলােতে ভিড় জমাতে থাকে। স্পেনের কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের আল আজহার ও ইরাকের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও উন্নত ছিল।
কুরআন, আরবি ব্যাকরণ ও কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে স্পেনে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হতাে। উচ্চশিক্ষার মধ্যে তাফসির, ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, আরবি-ব্যাকরণ, অভিধানশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগােল, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হতাে। স্পেনের শিক্ষা এবং সংস্কৃতির বিপুল উন্নতি সেখানকার শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ এবং বিশ্বখ্যাত গ্রন্থাগারের বইয়ের সংগ্রহ দেখে বােঝা যায়।
*নোট: 'বায়তুল হিকমা' হলো বিজ্ঞানাগার বা গবেষণাগার। আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদ (বর্তমানে ইরাকের রাজধানী) নগরীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। 'বায়তুল হিকমা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিমদের বিজ্ঞানচর্চায় এক নতুন মাইলফলক স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এটি মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। চিকিৎসাবিদ্যাসহ গণিত, ভূগােল, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে 'বায়তুল হিকমা'র অবদান অনন্বীকার্য।
তথ্যসুত্র : বই - ইসলাম শিক্ষা।
লেখক: ড. এ আর এম আলী হায়দার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন