প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান

প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান - বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet

প্রযুক্তি কাকে বলে?

প্রযুক্তি (Technology) বলতে বিজ্ঞানের ব্যাবহারিক দিককে বােঝায়। অক্সফোর্ড ডিকশনারি- তে প্রযুক্তি- র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, The application of scientific knowledge for practical purposes. প্রযুক্তি বলতে কিছু প্রায়ােগিক কৌশলকে বােঝায়, যার সাহায্যে মানুষ প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে নিজের প্রয়ােজনে সহজে ও দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারে। যেমন- আগে মানুষ যােগাযােগের জন্য উচু পাহাড়, সৃষ্ট প্রতিধ্বনি। আগুনের ধোঁয়া প্রভৃতি ব্যবহার করত। কিন্তু যােগাযােগ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মানুষ এখন কম্পিউটার, রেডিও, টেলিভিশন, মােবাইল, স্যাটেলাইট প্রভৃতি ব্যবহার করছে। 

প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্র

যােগাযােগ ছাড়াও প্রযুক্তির আরও নানাবিধ ক্ষেত্র রয়েছে। মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি দিকের সাথেই প্রযুক্তি জড়িত। একেকটি প্রযুক্তির সংযােজন ও উন্নয়ন মানবজীবনের একেকটি দিককে করেছে বিশেষভাবে প্রভাবিত। প্রযুক্তির কয়েকটি উল্লেখযােগ্য ক্ষেত্র হলাে: জৈব প্রযুক্তি, মহাকাশ প্রযুক্তি, যােগাযােগ প্রযুক্তি, চিকিৎসা প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি, নৌ প্রযুক্তি, ন্যানাে প্রযুক্তি, রাসায়নিক প্রযুক্তি, কৃষি প্রযুক্তি, নির্মাণ প্রযুক্তি প্রভৃতি।

প্রযুক্তির ধারা

প্রযুক্তির ধারা অত্যন্ত গতিশীল ও নিত্য পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে মানবসভ্যতার যেমন বিবর্তন ঘটেছে তেমনি মানুষ নিত্যদিনের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে প্রযুক্তিরও উন্নয়ন করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজকে করেছে সহজ থেকে সহজতর। মহান আল্লাহ তায়ালা ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। বাকি সব মাখলুকাত মানুষের প্রয়ােজনে ব্যবহারের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বের সব সৃষ্টিই সরাসরি মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগানাে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার কিছু পরিবর্তন,পরিবর্ধন ও সংযাজন। এজন্যই মানুষ প্রযুক্তির সাহায্য নেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিভিন্নভাবে মানুষকে প্রযুক্তির প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির পরেই আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের বিভিন্ন বিষয়ের নাম ও সেগুলাের ব্যবহার শিখিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলাে বিশ্বের সব জ্ঞানের উৎস। এমন কোনো বিষয় নেই যার ইঙ্গিত কুরআনে নেই।

আরও পড়ুনঃ

প্রযুক্তি সম্পর্কে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত

  • প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। যেমন: খাদ্য সংরক্ষণে প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সুরা ইউসুফের ৪৭-৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- 'তােমরা ক্রমাগত সাত বছর উত্তমরুপে ফসল ফলাতে থাকবে। অতঃপর ফসল তােলার সময় এলে তােমরা যে পরিমাণ ফসল তুলতে চাও তার মধ্য থেকে সামান্য অংশ তােমাদের খাবারের জন্য রাখবে, তা বাদ দিয়ে বাকি অংশ শীষ সমেত রেখে দেবে। এরপর সাতটি কঠিন (খরার) বছর আসবে, এ দিনের জন্য তােমরা যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে, কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত যা তােমরা (বীজের জন্য) তুলে রাখবে।'

এছাড়াও মানুষের জীবনকে আরও সহজ, সুন্দর, সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করার জন্য আল্লাহ কুরআন ও তাঁর নবির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। নিচে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ বস্তব্য তুলে ধরা হলাে:
  • পােশাক প্রযুক্তির প্রতি ইঞ্জগিত দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: 'জান্নাতে তাদের স্বর্ণ-কঙ্কণে অলংকৃত করা হবে এবং তারা পাতলা ও মােটা রেশমের সবুজ কাপড় পরিধান করবে (সুরা কাহফ: ৩১)।
  • গৃহস্থালির বিভিন্ন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি তৈরির প্রযুক্তি উৎকর্ষের জন্য পশুর চামড়া ব্যবহারে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ বলেছেন: চতুষ্পদ জন্তুর চামড়া দিয়ে তােমাদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করেছেন। তােমরা এগুলােকে সফরকালে ও অবস্থানকালে পাও। ছাগল এর পশম, উট এর বাবরিচুল এবং ভেড়ার পশম দিয়ে কত ব্যবহারের সামগ্রী ও আসবাবপত্র তৈরি করেছেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (সুরা নাহল: ৮০)।
  • যাতায়াতের সুবিধার জন্য ও মানব পদচারণা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে আল্লাহ নৌ-প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সুরা হুদ এর ৩৭-৩৮ নং আয়াতে হযরত নূহ (আ) এর কাহিনি বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন:আর তুমি একটি নৌকা তৈরি কর আমার চোখের সামনে ও আমার ওহী অনুসারে ' ( সুরা হুদ: ৩৭)
  • বাতাসকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শুন্যে ভেসে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যে যাওয়া যায় এই ধারণা আমরা পাই হযরত সুলায়মান (আ) এর ঘটনা থেকে, যা থেকে মানুষ 'এরােস্পেস' এর প্রযুক্তিগত ইঙ্গিত পায়।
  • লােহা ও তামার ব্যবহার প্রযুক্তির উন্নয়নকে করেছে ত্বরান়িত। এ সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে আল কুরআনের সুরা সাবা-এর ১০-১৩ নং আয়াতে। আল্লাহ বলেন, (আমি তাকে বলেছিলাম, সে বিগলিত লােহা দিয়ে) তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করো এবং সেগুলাের কড়াসমূহ যথাযথভাবে সংযুক্ত করাে (সুরা সাবা: ১১)

প্রযুক্তিতে মুসলিম মনীষীদের অবদান

কুরআন ও হাদিসের এরূপ ইঙ্গিতপূর্ণ বিভিন্ন বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে এবং গবেষণা করেই মুসলিম মনীষীগণ প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় নিজ নিজ অবদান রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের অবদান নিচে তুলে ধরা হলাে :
  • কাগজ আবিষ্কারের আগে সাহাবিগণ ওহি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করতেন গাছের পাতা, বাকল, পাথর প্রভৃতি। ৭০৪ খ্রি, সমরখন্দ মুসলমানদের আয়ত্তে আসলে চীনের কাগজ শিল্পে প্রযুক্তির প্রাথমিক স্তরের ব্যাপক উন্নয়ন করেন মুসলমানগণ।
  • মুসলিম বিজ্ঞানী আল জাজারী (১১৩৬-১২০৬ খ্রি.) ঘূর্ণায়মান হাতল আবিষ্কারের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের যন্র তৈরি করেন, যা হাইড্রো পাওয়ার প্রযুক্তিতে চলত। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই তার তৈরি এ যন্ত্রের ব্যবহার হতাে। তিনি পানিচালিত জলঘড়িও তৈরি করেছিলেন।
  • স্পেনের বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী আব্বাস ইবনে ফারনাস (৮১০-৮৭৫ খ্রি.) সর্বপ্রথম সূক্ষ ক্রোনােমিটার ও চশমা আবিষ্কার করেন।
  • মিশরের মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে ইউনুস (৯৫०-৯৯৬) ঘড়িতে পেন্ডুলামের সফল ব্যবহার করেন।
  • ইবনে সিনা (চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক) তার মায়ার আল আকল এ কপিকল ভারােক্তোেলক, স্ক্র, গোঁজ, চরকি এর ব্যবহার সম্পর্কে প্রথম আলােকপাত করেন।
  • মহাবিজ্ঞানী যাকারিয়া আল রাযি নবম শতাব্দীতে কেরােসিন উৎপাদন পদ্ধতি আবিষ্কার করে তৈরি করেন নাফাতাহ্ বা কেরােসিনের বাতি। তিনি কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরির পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন।
  • চিকিৎসা প্রযুক্তিতে ইবনে সিনাকেই জনকের আসন দেওয়া হয়। আল রাযি, হাসান ইবনে হায়সাম প্রমুখ মনীষীগণ শরীরের বাড়তি গােশত কাটা, হাড় কাটা, দাঁত তােলা, ক্ষত সেলাই করা প্রভৃতি কৌশলী যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রযুক্তিতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিলেন।
  • হাসান ইবনে হায়সামের তৈরি করা 'ম্যাগনিফাইং গ্লাস' গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল । এটি বর্তমানেও গবেষণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • জ্যোতির্বিজ্ঞানেও মুসলমানরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের মধ্যে ইব্রাহীম আল ফাজারী হলেন প্রথম প্রযুক্তিবিদ, যিনি সূর্য ও নক্ষত্রের উচ্চতা নির্ণয়ের সহায়ক যন্ত্র অ্যাস্ট্রলেইব (Astrolabe) নির্মাণ করেন। এছাড়াও একাদশ শতাব্দীর দিকে সূর্যের উচ্চতা নির্ণয়ের নিমিত্তে মুসলিম বিজ্ঞানী আবু মােহাম্মদ আল খুজাব্দী তৈরি করেন 'আস সুদ আল ফাখরী এবং 'আল আলা-আস সামিল' নামে দুটি যন্ত্র। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে জনাব নাসিরউদ্দিন তুসী একটি 'মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে "ইকুয়েটেরিয়াম' নামে গ্রহসমূহের অবস্থান নির্ণয়ে সহায়ক একটি যন্ত্র তৈরি করেন মুসলিম জ্যোতির্বিদ জামশিদ গিয়াসউদ্দিন আল কামী।
  • মুসলমান পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভারতের ড. এ. পি. জে আব্দুল কালাম ও পাকিস্তানের ড. আব্দুল কাদির খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

এছাড়াও পােশাক প্রযুক্তির উন্নয়ন মুসলমানদের হাত ধরেই হয়েছিল। কুফাতে তৈরি মেয়েদের ওড়না কুফিয়া বাগদাদের 'বাদাচিন', মাওসিলের, 'মসলিন' মিসরের ফুসতাতের কাপড় 'ফাসতিযান' প্রভূতি কাপড় তৈরির উন্নত প্রযুক্তির স্বাক্ষর বহন করে। বর্তমানেও ইরানের কার্পেট ও সিরামিক শিল্প বিখ্যাত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ বর্তমানে তৈরি পােশাক রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ।

ওপরের আলােচনা থেকে বলা যায়, মানুষ তার প্রয়োজন পূরণে প্রযুক্তির উন্নয়নে সর্বদাই সচেষ্ট ছিল। আর এ সব উন্নয়নে মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। মুসলমানগণই ছিলেন এই উন্নয়নের পথ প্রদর্শক। বর্তমানের এই আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, যার শুরুটা হয়েছিল মুসলমানদের হাতেই।

তথ্যসূত্র : বই - ইসলাম শিক্ষা
লেখক: ড. এ আর এম আলী হায়দার

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন