Skip to content Skip to sidebar Skip to footer

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর জীবনী

ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) এর জীবনী - বঙ্গ টুইট - Bongo Tweet

হাজ্জাজ বিন ইউসূফ নামক জালিম শাসক এর জুলুম আর নির্যাতনে তখনকার আলেম ও জ্ঞানী -গুণী দের কোণঠাসা অবস্থা। হাজ্জাজ বিন ইউসূফ এর জুলুম আর নির্যাতনের ভয়ের কারণে সেই সময়ে প্রকাশ্যে জ্ঞানচর্চা করার অবকাশ ছিলো না। ঠিক সেই সময় জন্ম হয় ইমামে আযম হযরত আবু হানিফার (রাহি)।



ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর পরিচয়

নাম : ইমামে আযম হযরত ইমাম আবু হানিফা (র) এর প্রকৃত নাম হচ্ছে নুমান বিন সাবিত। আবু হানিফা হচ্ছে তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম। তিনি এই নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর উপাধি হচ্ছে ইমাম আযম।

জন্ম : উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান এর রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করেন। ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ এবং ৮০ হিজরি সালে শাবান মাসের ৪ তারিখে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং কুফা নগরীতেই লালিত-পালিত হন। 

পিতার নাম : ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর পিতার নাম সাবিত বিন যুতী কাবুল। সাবিত বিন যুতী আফগানিস্তানের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার বয়স যখন ৪০ বছর তখন ইমাম আবু হানিফা (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) পিতৃহারা হন। 

বংশ তালিকা : ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর বংশ তালিকা নিম্নরপ- আবু হানিফা নােমান বিন সাবেত, যুতী কাবুল ইবনে মারযুবান। ইমাম আবু হানিফার বংশ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আবু হানিফা (রহ.) এর দাদার নাম যুতী হওয়ার কারণে তাকে বংশধরের দিক থেকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়ে থাকে। খতীবে বাগদাদী একজন প্রখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ। তিনি ইমাম আবু হানিফার নাতি ইসমাইল বিন হাম্মাদ এর বক্তব্য থেকে ইমাম আবু হানিফার বংশ ব্যাখা দেন। অন্য আরেকজন ইতিহাসবিদ বলেন হাম্মাদ ইমাম আবু হানিফাকে পারসিক বংশদ্ভূত বলে দাবি করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মত হলো তিনি কাবুলের পারসিক বংশদ্ভূত।



আবু হানিফা (রহ.) এর প্রাথমিক জীবন

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রাথমিক জীবনে ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। তার পিতা সাবিত বিন যুতী ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ১৬ বছর বয়সে আবু হানিফা (রহ.) পিতৃহারা হয়ে যান। পিতার মৃত্যুর পর এই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফাকে। ইমাম আবু হানিফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, ইলমের সেবা এবং তার নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। 

ইমাম আবু হানিফা (র) তিনি তার অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড় তৈরি করারন একটি কারখানা স্থাপন করেন। এটি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে। তার ব্যবসার মধ্যে সততার পরিচয় পেয়ে চারিদিক থেকে লোকেরা তার দোকানে মধ্যে এসে ভিড় জমাতেন। এইভাবে আবু হানিফা (র) জন মানুষের নিকট ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করেন। সর্বপ্রথম ইমাম শাবী (রহ.) ইমাম আবু হানিফা (র) কে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। এর আগ পর্যন্ত ইমাম আবু হানিফা (র) এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন।



ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর শিক্ষা জীবন

১৬ বছর বয়সে তিনি বাবার সাথে হজ্বে গিয়ে ইলমে হাদিসের দরসে প্রথম যোগ দেন। বাবার অনুপস্থিতিতে কাপড়ের ব্যাবসা দিয়ে শুরু হয় তার কর্মজীবন। ইলমে ফিকহ ও হাদিসের প্রবল আকর্ষণে ব্যবসা ছেড়ে মনোনিবেশ করেন জ্ঞানের এই জগৎ এ। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়,ডুব দেয় জ্ঞানবিশ্বে। মাত্র ২০ বছরের মধ্যে ইলমে ফিকহ,ও ইলমে হাদিসে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেওয়া নোমান নামক ছেলেটি হয়ে যায় বিশ্ববিখ্যাত ইমাম। 

তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ইমাম জাফর সাদিক এর তত্ত্বাবধানে । খুব কম বয়সে ইমাম আবু হানিফা (র) অসাধারণ মেধা ও তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিতে তাফসির গ্রন্থ, হাদিস গ্রন্থ, বালাগাত ও অন্যান্য শাস্ত্রে প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করেন। এ সময়ে তিনি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খাদেম বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক (র) এর খিদমতে হাজির হন। কিন্তু বয়ঃকনিষ্ঠতার জন্য কোনাে হাদিস শিখতে ব্যর্থ হন।

১০০ হিজরিতে ইমাম আবু হানিফা (র) ইলমে আদব ও ইলমে কালাম শেখার পর তিনি ইলমে ফিকহ অর্জনের জন্য সমকালীন ফকিহ ইমাম হাম্মাদ বিন আবু সুলাইমান আল-আশআরী এর শিক্ষালয়ে ভর্তি হন। ইমাম হাম্মাদ ছিলেন তার বিশেষ ওস্তাদ। ১১০ হিজরি পর্যন্ত এখানে গভীর নিষ্ঠার সাথে তিনি জ্ঞানার্জন অব্যাহত রাখেন। এরপর কুফার মুহাদ্দিসদের কাছে হাদিস অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। কিন্তু তিনি বেশি আগ্রহবােধ করেন ইসলামিক আইনে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর গুরুজনের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার।

 
আরও পড়ুনঃ

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর কর্ম জীবন

পড়াশুনা শেষ করে পৈত্রিক কাপড়ের ব্যবসা দিয়ে ইমাম আবু হানিফা (র) কর্মজীবন শুরু করেন। গ্রামে, শহরে বিভিন্ন জায়গায় নিজের ব্যবসাকে বিস্তৃত করেন। সমকালে ইমাম আবু হানিফা (র) ধন সম্পত্তিতে অগ্রগণ্য ছিলেন। অধিক অর্থ থাকায় বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করে ইমাম আবু হানিফা নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান।

১২০ হিজরিতে ইমাম হাম্মাদ (র) ইন্তেকাল করলে ব্যবসায়ের পাশাপাশি আবু হানিফা (র) ওস্তাদের শিক্ষালয়ের দায়িত্ব নেন। ১৫০ হিজরিতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ইমাম আযম আবু হানিফা (র) এ শিক্ষালয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় অসংখ্য শিক্ষার্থী তাঁর কাছে ফিকহ শাস্ত্র (ইসলামিক আইন শাস্ত্র) শেখেন। 

এদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম যুফার প্রমুখ মনীষীগণ অন্যতম। ইমাম আবু হানিফা (র) নিজের তীক্ষ্ণ মেধা, প্রতিভা, অসাধারণ ধীশক্তি, দীনি জ্ঞানের রাজ্য, অতুলনীয় বাগ্মিতা ইত্যাদি গুণাবলির মাধ্যমে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (র) এর পূর্বে ফিকহ শাস্ত্র ইসলামি কোনাে স্বতন্ত্র শাস্ত্র ছিল না। ইমাম আবু হানিফা (র) প্রথম ফিকহ শাস্ত্র কে বিন্যস্ত স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা দেন। ফিকহ শাস্ত্র সম্পাদনার কাজ সুসম্পন্ন করার জন্য তিনি ১৩২ হিজরিতে একটি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নিজের শ্রেষ্ঠতম ৪০ জন ফকিহ শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি 'সম্পাদনা পরিষদ' এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দশজনকে নিয়ে 'পর্যালােচনা পরিষদ' গঠন করে তিনি ফিকহ সংকলনের বিধিবদ্ধ ধারার সূচনা করেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (র) এর নিবিড় তত্ত্বাবধান, প্রত্যক্ষ মতামতদান ও বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে দীর্ঘ বাইশ বছরে ফিকহ শাস্ত্রের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ সংকলন সমাপ্ত হয়। এতে ৮৩ হাজার মাসয়ালা  প্রাথমিকভাবে স্থান পায়। এগুলাের নাম রাখা হয় 'কুতুবে হানাফিয়া'। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ সংকলনকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত এতে ৫ লাখ মাসয়ালা সংকলিত হয়।



সাহাবিদের (রা.) সাথে সাক্ষাৎ লাভ

প্রসিদ্ধ চারজন ইমামের মধ্যে কেবল মাত্র ইমাম আবু হানিফা (র) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাহাবিদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। তিনি সাতজন সাহাবিদের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাক্ষাৎ  পেয়েছিলেন। নিচে সাতজন সাহাবির নাম দেওয়া হল-
  • ১. হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.)
  • ২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা (রা.)
  • ৩. হযরত সহল ইবনে সা'আদ (রা.)
  • ৪. হযরত আবু তোফায়েল (রা.)
  • ৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়দি (রা.)
  • ৬. হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)
  • ৭. ওয়াসেলা ইবনুল আসকা (রা.)


ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর কারাবরণ

আব্বাসীয় খলিফা আল-মানসুর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়ােগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর খলিফা আল মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, 'আমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকি তাহলে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ একজন মিথ্যাবাদিকে কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে বসাবেন।' এই ব্যাখ্যার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাবন্দি করে রাখেন।



ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর ইন্তেকাল

৭৬৭ খ্রিস্টাব্দ ১৪ জুন এবং ১৫০ হিজরি সালে প্রায় ৭০ বছর বয়সে ইমাম আবু হানিফা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কারো মতে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) খলিফা আল মনসুরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্টা করেন। আর এই জন্য তাকে জেলখানার ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ বলেন বন্দি অবস্থায় ইমাম আবু হানিফা (র) এর ওপর বিষ প্রয়ােগ করা হয়। সিজদারত অবস্থায় শহিদ হন তিন। ইতিহাসখ্যাত মহান এ জ্ঞানসাধক মনীষীকে বাগদাদে দাফন করা হয়।


তথ্যসূত্র:-
বই: সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) ও চার ইমামের অবস্থান
লেখক: মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ খান মাদানী